Ads

সনাতন হিন্দু ধর্মকে জানুন কীতাব পড়ুন শিখুন এবং প্রশ্ন করুন. বিনামূল্যে সকল বইগুলো অনলিনেই সরাসরি পড়তে পারবেন অন্যদের পড়ার জন্য শেয়ার করবেন, নতুন পোস্ট পেতে ফাসেবুকে লাইক দিয়ে রাখুন |

দুর্গা পূজা কী ও কেনো করা হয়?

রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭
দুর্গা পূজা কী ও কেনো ?

(২০১৭ সালের আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে, এই প্রবন্ধটি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে জনে জনে বিলি করার উদ্যোগ নিয়েছে। যদি কেউ বাংলাদেশে এটা প্রকাশ করতে চান, আমার সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন, আমি আরও কিছু ইন্সট্রাকশন দেবো।)

দুর্গতি নাশ বা সংকট মোচন করেন ব’লেই তিনি দুর্গা। কিন্তু এই দুর্গা আসলে কে ? সাধারণভাবে আমরা জানি, অুসররা যখন দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ দখল করেছিলো, তখন সকল দেবতার মিলিত শক্তিতে দেবী দুর্গার উৎপত্তি হয় এবং এই দুর্গা অসুরদের পরাজিত করে দেবতাদের বাসস্থান, স্বর্গ উদ্ধার করে দেয়। তাহলে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সকল দেবতার মিলিত শক্তিতে সৃষ্ট নারীরূপী দুর্গা যদি একা সকল অসুরকে পরাজিত করতে পারে, তাহলে সকল দেবতা মিলে তা করতে পারলো না কেনো ? এখানে শক্তি তো সমান ?

এখন নেট-ফেসুবক ও প্রশ্নের দুনিয়া, তাই বিভিন্ন ধর্মের বিধি বিধান নিয়ে অনলাইন ছাড়াও অফলাইনে লোকজন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে, এর মধ্যে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অন্যদের আক্রমনই বেশি, তাই হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষয় ঠেকাতে এবং হিন্দুধর্ম সম্পর্কে হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে ও ফিরিয়ে আনতে, হিন্দুধর্মের পালনীয় প্রথার গূঢ়তত্ত্ব সম্পর্কে সকল কিছু, সকল হিন্দুর জানা একান্ত জরুরী, তা না হলে অন্য ধর্মের আগ্রাসী আক্রমনে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই আপনাদের জন্য দুর্গাপূজা উপলক্ষে, দেবী দুর্গা এবং এ প্রসঙ্গে অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমার এই নিবেদন।

হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন পরমব্রহ্ম, যাকে শুধু ‘ব্রহ্ম’ও বলা হয়। এই ব্রহ্ম তিনটি রূপে তার কাজ সম্পন্ন করে থাকেন- ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি, বিষ্ণু রূপে পালন এবং মহাদেব বা শিব রূপে ধ্বংস। কিন্তু অজ্ঞতা ও বিকৃত ব্যাখ্যার কারণে আমরা এতদিন অনেকেই মনে করেছি বা জেনে এসেছি যে, ব্রহ্মের তিনটি রূপ বা ব্রহ্ম তিনভাগে বিভক্ত, যথা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাই আমরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরকে আলাদা আলাদা তিনটি সত্ত্বা বিবেচনা করেছি এবং তাদের আলাদা মূর্তি প্রথমে কল্পনা ও পরে তৈরি করেছি; শুধু তাই নয়, তাদের প্রত্যকের স্ত্রী সৃষ্টি করেছি, পরে বহু দেবতার জন্ম দিয়েছি, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সেরকম কিছু নয়।

একজন লেখক যখন কল্পনা করে কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখে, তখন লেখক কিন্তু একাই সমস্ত চরিত্র সৃষ্টি করে। এর মানে হলো নায়কও লেখক, নায়িকাও লেখক, নায়ক-নায়িকার পিতা-মাতাও লেখক আবার ভিলেন এবং সকল পার্শ্ব চরিত্রও লেখক। অর্থাৎ লেখক একাই ঐ গল্প বা উপন্যাসে সবাইকে সৃষ্টি করে এবং যাকে যেভাবে ইচ্ছা চালিত করে এবং যার মুখ দিয়ে যা খুশি সংলাপ বের করে। ঠিক একইভাবে এই মহাবিশ্ব, তার মধ্যে পৃথিবী এবং তার উপর মানুষসহ সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করে পরমব্রহ্ম সেই একই কাজ করে চলেছে, এখানে আর কারো কোনো ভূমিকা নেই, সকল ভূমিকা কেবল ঈশ্বররূপী পরমেশ্বর বা পরমব্রহ্মের। ঠিক এই কথা ই বলা আছে, দেবী দুর্গার শুম্ভ নিশুম্ভ বধ প্রসঙ্গে। এই যুদ্ধের সময় অসুররা দুর্গার বিরুদ্ধে রক্তবীজ নামক এক দৈত্যকে প্রেরণ করে, এই রক্তবীজের বৈশিষ্ট্য হলো তার দেহ থেকে রক্ত মাটিতে পড়লেই তা থেকে আবার নতুন অসুরের উৎপত্তি হয়। রক্তবীজের রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে, সেজন্য দুর্গা নিজের থেকেই কালীকে সৃষ্টি করে, তখন কালী রক্তবীজের রক্তপান করে তাদের উৎপত্তি বন্ধ করে। এভাবে দুর্গা সমস্ত অসুরকে হত্যা করে। এটা দেখে শুম্ভ দেবী দুর্গাকে বলে,

“তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।”

তখন দেবী দুর্গা বলে,

“একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা।
পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।”

অর্থাৎ, একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে ? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এরপর অন্যান্য সকল দেবী, যাদেরকে দুর্গা, কালীর আগে সৃষ্টি করেছিলো, তারা সবাই দুর্গার দেহে বিলীন হয়ে যায় এবং দুর্গা, শুম্ভকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করে।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্গা কেনো বললো যে, একা আমিই এ জগতে বিরাজিত ? আসলে দুর্গা মানেই তো শিব বা মহেশ্বর, আর মহেশ্বর মানেই পরমব্রহ্ম।

এই কথা ই আবার শ্রীকৃ্ষ্ণ বলেছেন গীতার সপ্তম অধ্যায়ে। কেননা, গীতার সপ্তম অধ্যায়ের মূল কথা হলো, “এই জগতের সকল কিছুই আমা হতে উৎপত্তি, আর জগতের এমন কিছু নেই যাতে আমি নেই।” তাহলে কৃ্ষ্ণ কেনো এই কথা বললেন ? আসলে কৃষ্ণ যেহেতু বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার, সেহেতু কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু এবং আগেই ব্যাখ্যা দিয়েছি বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম।

তাহলে এখানে অন্য প্রশ্ন হচ্ছে, এত দেব-দেবী এলো কোথা থেকে ?

আমাদের পরমজ্ঞানী মুনি-ঋষিরা, পরমব্রহ্ম কর্তৃক এই বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই দেব-দেবীগুলোকে নানা ভূমিকায় কল্পনা করে নিয়েছেন বা ধরে নিয়েছেন, যেমন আমরা কোনো অঙ্ক সমাধান করতে গিয়ে ‘এক্স’কে ধরে নিই। কিন্তু বাস্তবে আসলে এক্স কিছুই না, কিন্তু এই এক্স একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমাদেরকে সাহা্য্য করে মাত্র। আমাদের দেব-দেবীগুলো পরমব্রহ্মকে খুঁজে বের করার বা তাকে উপলব্ধি করার এই এক্স।

তাহলে এখানে আবারও প্রশ্ন আসতে পা্রে যে, এই মুনি-ঋষিদের কথা ই যে সত্য, সেটা আমরা বুঝবো কিভাবে, আর মুনি ঋষিদের কথাকে আমরা সত্য বলেই বা মানবো কেনো ?

অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, শুধু একটি প্রমান দিই, আমাদের সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো, যেগুলোকে এখনও আমরা খালি চোখে ‘তারা’ বা স্টার ব’লে মনে করে থাকি, যেগুলোর মধ্যে পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশি এবং উপগ্রহ চাঁদ ছাড়া আর কোনো গ্রহে মানুষ এখন পর্যন্ত যেতেই পারে নি, যে গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানীরা জানা শুরু করেছে মাত্র কয়েকশত বছর আগে থেকে, কিন্তু ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র, যেটা হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ‘বেদ’ এর অংশ, যা আমাদের মুনি-ঋষিরা লিখে গিয়েছেন ৮/১০ হাজার বছর আগে, সেই জ্যোতিষ শাস্ত্রে শুধু আমাদের সৌরজগতের প্রধান গ্রহগুলো সম্পর্কেই নয়, আমাদের সৌরজগতকে ঘিরে থাকা ২৭টি নক্ষত্র সম্পর্কেও তারা বলে গেছেন।

মুনি-ঋষিরা গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে যা বলে গেছে তার সবগুলো তো এখানে আর উল্লেখ করা সম্ভব নয়, আপনাদের জানাশোনার মধ্য মাত্র একটি উদাহরণ দিই, মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন মঙ্গল গ্রহের রং লাল, এখন বিজ্ঞানীরা তাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করে বলছে যে, হ্যাঁ, মঙ্গল গ্রহের রং লাল। তাহলে সেই ৮/১০ হাজার বছর আগে আমাদের মুনি-ঋষিরা সেটা জানলো কিভাবে ? তারা তো আর মঙ্গল গ্রহে গিয়ে দেখে এসে ঐ তথ্য লিখে নি;  শুধু তাই নয়, জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে চাঁদের প্রভাবে পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়, এখন বিজ্ঞানীরা বলছে, হ্যাঁ, তাই। তাহলে এই মুনি-ঋষি, যাদের সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাকে ভাবলে শুধু অবাকই হতে হয়, তাদের কথাকে আপনি বিশ্বাস করবেন কিভাবে বা কেনো ?

যারা জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, তাদেরকে বলছি, এই মুনি-ঋষিরাই বলে গেছেন, মানুষের জীবনের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব এবং তার ফলাফলের কথা, তাহলে তাদের সেই কথাকে আপনি অবিশ্বাস করবেন কিভাবে ? আপনি হয়তো কোনো জ্যোতিষীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন বা কারো প্রতারিত হওয়ার গল্প শুনেছেন, তার মানে তো এই নয় যে জ্যোতিষ শাস্ত্র ভূয়া! প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার জন্য ডাক্তার খারাপ হতে পারে, তাই বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান যেমন ভূয়া নয়, তেমনি জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে জ্যোতিষী ভূয়া হতে পারে কিন্তু জ্যোতিষ শাস্ত্র এক বিন্দুও মিথ্যা নয়।

যা হোক, ফিরে যাই দুর্গার গল্পে। উপরেই উল্লেখ করেছি-ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর আলাদা আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়; ব্রহ্ম যখন সৃষ্টির কাজ করেন তখন তিনি ব্রহ্মা, যখন তিনি পালনের কাজ করেন তখন তিনি বিষ্ণু, আর যখন তিনি ধ্বংসের কাজ করেন, তখন তিনিই মহেশ্বর। একটি উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও সহজ হবে; ধরে নিন, প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রীর হাতে তিনটি মন্ত্রণালয় আছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ঐ মন্ত্রণালয়গুলোও দেখাশোনা করেন। এই অবস্থায় তিনি যে মন্ত্রণালয়ের হয়ে ফাইলে সই করেন বা করবেন, তখন কিন্তু তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং ব্রহ্মের ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। তাই যদি না হয় তাহলে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার কৃষ্ণ, পালনের পাশাপাশি যুদ্ধ ও হত্যার মাধ্যমে পাপী ও দু্ষ্টদের বিনাশ করেছেন কেনো ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে যদি আলাদা আলাদা সত্ত্বা্ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের কাজ ছিলো শুধু পালন করা, তার তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধানোর কোন প্রয়োজন ছিলো না; প্রয়োজন ছিলো না শিশুকালেই রাক্ষসী ও অসুরদের, পরে কংস ও শিশুপালকে হত্যা করার এবং ভীমের মাধ্যমে জরাসন্ধ ও দুর্যোধনকে হত্যা করানোর ? আসলে কৃষ্ণ মানেই বিষ্ণু, আর বিষ্ণু মানেই পরমব্রহ্ম। এজন্য বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার হিসেবে শুধু মানবরূপী কৃষ্ণই নয়, প্রত্যেকটি মানুষ ই যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন এক অর্থে সে ই ব্রহ্মা, যখন কাউকে পালন করে তখন বিষ্ণু এবং যখন কাউকে ধ্বংস করে তখন শিব। এভাবে এবং এইসব রূপেই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে পরমব্রহ্ম বাস করে। এজন্যই ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩/১৪/১) ও বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে,

“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”
অর্থাৎ, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম বিদ্যমান।
বা প্রচলিত কথায়, “যত জীব, তত শিব”।

আগেই উল্লেখ করেছি, ব্রহ্ম যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করে তখন তার নাম হয় ব্রহ্মা, আর যেকোনো কিছু সৃষ্টি করতেই লাগে জ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়ম হলো নারী ও পুরুষের মিলন ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি বলতে সাধারণ অর্থে এখানে মানুষকেই বোঝানো হচ্ছে, তো প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ব্রহ্মার নারীশক্তি হলো সরস্বতী, যাকে আমরা স্থূল অর্থে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কল্পনা করে নিয়েছি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই, এমনকি ব্রহ্মা বলেও আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই; লেখক কর্তৃক- গল্প, উপন্যাসে একাধিক চরিত্র সৃষ্টির মতো সবই ব্রহ্মের খেলা, এখানে ব্রহ্মই সবকিছু । যা হোক, কোনো কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করতে হলে যেমন জ্ঞান লাগে, তেমনি সৃষ্টিকে নিখুঁত করার জন্য নজর রাখতে হয় চারেদিকে, এজন্যই কল্পনা করা হয়েছে ব্রহ্মার চারটি মাথা এবং তার নারীশক্তি সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে জ্ঞানের দেবী হিসেবে।

এবার আসা যাক বিষ্ণুতে। বিষ্ণু হলো ব্রহ্মার পালনকারী রূপের নাম। তো কাউকে পালন করতে কী লাগে ? ধন-সম্পদ। এই জন্যই বিষ্ণুর নারী শক্তি হলো লক্ষ্মী এবং সে ধন-সম্পদের দেবী।

এবার আসি শিব বা মহেশ্বরে। ব্রহ্মের ধ্বংকারী রূপের নাম শিব, মহেশ্বর বা রুদ্র। সৃষ্টি বা পালন করতে যেমন লাগে নারী শক্তি, তেমনি ধ্বংস করতেও লাগে নারী শক্তি। একারণেই রামায়ণের সীতা ও মহাভারতের দ্রৌপদীর জন্ম। এছাড়াও বিখ্যাত, গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যকার যুদ্ধের কারণও ছিলো এক নারী, নাম হেলেন। নারী শক্তি যেমন ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তেমনি নারী নিজেও ধ্বংস করতে পারে। প্রকৃতির এই নিয়মকে স্বীকৃতি দিতেই ব্রহ্মের ধ্বংসকারী রূপ মহেশ্বর বা শিবের নারী শক্তি হলো দুর্গা, যার আরেক রূপের নাম কালী।

এই হলো হিন্দু শাস্ত্রের ইতিহাসে দুর্গার উৎপত্তির কাহিনী। কিন্তু এই কথাগুলোকে এই ভাবে না বলে আমাদের পুরাণ রচয়িতারা নানা ঘটনার মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন দেব-দেবীর জন্ম দিয়েছে, যে ঘটনাগুলো যুক্তি-তর্ক-প্রশ্নের বাইরে নয়। যেমন শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সকল দেবতার শক্তি মিলে উৎপত্তি দেবী দুর্গা যদি অসুরদের হত্যা করতে পারে, তাহলে সকল দেবতা মিলে তা করতে পারলো না কেনো ? এই ঘটনায় প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করা হয়েছে; কারণ, প্রকৃতির নিয়মই হলো একের চেয়ে বহুর শক্তি বেশি, কিন্তু এখানে দেখানো হয়েছে বহুর চেয়ে একের শক্তি বেশি, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করলে তার একার শক্তির দ্বারাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সমগ্র কুরুবংশকে ধ্বংস করতে পারতেন, রাম পারতেন রাবনের বংশকে বিনাশ করতে, কিন্তু তারা তা না করে একটি পদ্ধতিগত যুদ্ধের সাহা্য্য নিলেন কেনো ? কারণ, এটাই বাস্তব এবং তা লোকশিক্ষার উপযোগী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গার একার যুদ্ধ সম্পূর্ণ অবাস্তব।

এই প্রসঙ্গে পুরাণের গল্পগুলো নিয়ে কিছু বলা দরকার। পুরাণের গল্পগুলো রচিত হয়েছে বেদ এর সূত্র বা ক্লু নিয়ে। কিন্তু পুরাণ রচয়িতারা সব সময় ক্লুগুলো যে ঠিক মতো বুঝতে পেরেছে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে; কারণ, একই বিষয়ে একেক পুরাণে একেক রকমের কথা বলা আছে। উদারহণ হিসেবে বলছি- গনেশের উৎপত্তির গল্প আপনি যত পুরাণে পাবেন, সবটাতেই দেখবেন আলাদা আলাদা গল্প। সবাই যদি বেদ এর সূত্রগুলো ঠিক মতো বুঝতে পারতো তাহলে সব গল্প একইরকম হতো। পুরাণের গল্প সম্বন্ধে আর একটা কথা খুব বেশি মনে রাখা দরকার যে, ওগুলো শুধুই গল্প, বাস্তবে কোনোদিন কোথাও এই ঘটনাগুলো ঘটে নি, শুধু লোকশিক্ষার জন্য আমাদের পুরাণ রচয়িতারা এই গল্পগুলো লিখেছে।

দেব-দেবীর উৎপত্তি রহস্যের পর এবার দুর্গা পূজার প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। দুর্গা কাঠামোতে প্রথমেই যেটা নজরে আসে, সেটা হলো দুর্গার ১০ হাত। আমাদের পুরাণ রচয়িতারা দুর্গার আবির্ভাবের পর তাকে সুপারওম্যান হিসেবে পাওয়ার ফুল করার জন্য প্রথমে ৪ হাত, তারপর ৮ হাত, তারপর ১৬ হাত এবং সবশেষে ১৮ হাত পর্যন্ত দিয়েছিলো; কেননা যেহেতু প্রকৃতির নিয়ম হলো যত হাত তত শক্তি। কিন্তু এই ১৬/১৮ হাত অবাস্তব বিবেচনা করে, শেষ পর্যন্ত বাস্তবের ১০ দিককে ঠেকানোর জন্য তারা ১০ হাত ফাইনাল করে এবং এখন পর্যন্ত সেটাই জনপ্রিয় এবং সেটাই চলছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে সকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হলো- মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। দুর্গা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে যেমন- জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন।

দুর্গার হাতের পর নজরে আস দুর্গার পায়ের নিচে থাকা সিংহ। প্রচলিত মতানুযায়ী অনেকেই জানেন যে, দুর্গার বাহন হলো সিংহ। কিন্তু দেবতাদের এই বাহনের ধারণাটাই একটা মিথ্যা ধারণা। প্রত্যেক দেবতা এমনিতেই তো অসম শক্তির অধিকারী, তাদের আবার বাহনের প্রয়োজন কী ? বাস্তবতা বিবেচনা করলে সিংহ না হয় অনেক বড় ও শক্তিশালী, তাই সিংহের হয়তো দুর্গাকে বহন করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ময়ূরের কি কার্তিককে বহন করার ক্ষমতা আছে, না ইঁদুরের গনেশকে ? তাহলে ময়ূর ও ইঁদুরকে তাদের বাহন বলছি কেনো ? প্রকৃপক্ষে এই সব জীবজন্তু ঐসব দেব-দেবীর বাহন নয়, তারা প্রকাশ করে অন্য কিছু, এই লেখাটা পড়তে থাকুন, আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে আপনার কাছে ।

সিংহ হলো দুর্গার- তেজ, ক্রোধ ও হিংস্রতার প্রতীক। হ্যাঁ, এ কথা ই বলা আছে পদ্মপুরানে। যদিও পদ্মপুরানে বলা আছে দুর্গার ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম হয়, কিন্তু আমি আসলে দেব-দেবী ও তাদের বাহনদের জন্ম থিয়োরিতে বিশ্বাস করি না; কারণ তাতে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয় যেগুলোর উত্তর দেওয়া যুক্তিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সম্ভব হয় না। আগেই উল্লেখ করেছি, সকল দেব-দেবী, বিশ্বসৃষ্টি ব্যাখ্যার জন্য মুনি-ঋষিদের কল্পনা, তাই তাদের আবির্ভাবের ঘটনাকে জন্ম না বলে উৎপত্তি হিসেবে বর্ণনা করেছি এবং করছি; কারণ, জন্ম মানেই বায়োলজিক্যাল ব্যাপার, যেখানে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী নারী পুরুষের যৌনতা মাস্ট। কিন্তু পুরাণ কাহিনী মতে, কোনো দেব-দেবীর জন্মই বায়োলজিক্যাল নিয়মে হয়নি। আর দেব-দেবীদের বাহন হিসেবে যাদের বলা হয়, তারা, বিজ্ঞানের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে সভ্য মানুষ সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই আছে, তাই দেব-দেবীদের সাথের এক একটি প্রাণী, এক একটি প্রতীক মাত্র, যা মানুষকে শিক্ষা দেয় অনেক কিছু, যেটা আমি পরে এই লেখাতেই আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।

সিংহের পর, দুর্গার কাঠামোতে নজরে আসে মহিষ ও মহিষাসুরের। এটা অনেকেই জানেন যে, যে অসুরদেরকে হত্যা করার জন্য দুর্গার এই যুদ্ধ, সেই অসুরদের প্রধান, নানা রূপ ধারণ করতে পারতো;  এই অসুরের একটি পছন্দের রূপ ছিলো মহিষ, এর কারণ, একটি বাঘ বা সিংহের চেয়ে একটি মহিষের শক্তি অনেক বেশি, অসুরের এই রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতাকে বোঝানোর জন্যই দুর্গায় কাঠামোয় ব্যবহার করা হয় মহিষ এবং এই মহিষের নাম অনুসারেই ঐ অসুরের নাম মহিষাসুর।

দুর্গা পূজার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো, কিন্তু তার সাথে আমরা জুড়ে দিয়েছি-শিব, গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, নবপত্রিকাসহ আরও নানা কিছু, এর কারণ কী ? আসলে দুর্গা পূজা একটি মহাশক্তি ও মহামিলনের পূজা। সেকারণেই এই পূজায় সকল শক্তির মিলন ঘটানো হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, দুর্গা ছাড়া, দুর্গার সাথেই পূজিত অন্য সকল দেবতার পূজাই বছরের বিভিন্ন সময় করা হয়। এই যেমন- দুর্গা পূজার রেশ না ফুরাতেই লক্ষ্মী পূজা, তার কয় দিন পর দুর্গারই আরেক রূপ কালী পূজা, তার কয়দিন পর কার্তিক পূজা, কিছু দিন পর সরস্বতী পূজা, এরপর গণেশ পূজা। তারপরও দুর্গাপূজার সময় আবার এই সকল দেব-দেবীকে একত্রিত করা হয় মূলত দুর্গাপূজাকে একটা ব্যাপকতা দেওয়া এবং সকল শক্তির সম্বন্বয়ে একটি মহাশক্তির পূজায় পরিণত করার উদ্দশ্যে।

দুর্গার কাঠামোয় আর একটি রহস্যময় ব্যাপার হলো নবপত্রিকা। পত্রিকা মানে পাতা হলেও আসলে নবপত্রিকা হলো নয়টি গাছ। এগুলি হলো -

কদলী বা কলা, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব বা বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম, অশোক, মান, কচু এবং ধান। একটি পাতাযুক্ত কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি গাছ মূল ও পাতাসহ একত্র করে একজোড়া বেল সহ সাদা অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ। আর না জেনে আমরা এটাকেই মনে করে আসছি গনেশের বউ।

আবার আমরা অনেকেই মনে করি যে, লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গার মেয়ে, এই ভাবনার কারণ হলো, কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীসহ দুর্গার পূজা শুরু হয় কোলকাতায় ১৬১০ সালে। দুর্গার সাথে একই কাঠামোয় কার্তিক গনেশ লক্ষ্মী সরস্বতীকে দেখে খুব সহজেই একটি পরিবারের চিন্তা মাথায় এসেই যায়, এই ভাবনা থেকেই আমরা মনে করে আসছি যে লক্ষ্মী, সরস্বতী দুর্গার মেয়ে এবং সঠিক তথ্য না জেনে সেই ভুল বিশ্বাসকেই আমরা শত শত বছর ধরে সঞ্চারিত করে এসেছি আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়, দেবীদের উৎপত্তির ইতিহাসে, লক্ষ্মী-সরস্বতী, দুর্গারও সিনিয়র, যদিও তারা তিনজনই একই পদমর্যাদার দেবী; কারণ- সরস্বতী, লক্ষ্মী ও দুর্গা যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের নারী শক্তি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে একসাথে এতগুলো দেব-দেবীর পূজার করার দরকার কী ?

প্রথমে দুর্গা পূজা যখন শুরু হয় তখন শুধু দুর্গাকেই পূজা করা হতো এবং দুর্গার সাথে থাকতো মহিষ ও অসুর। দুর্গার প্রাচীন যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোতে এর প্রমান আছে। কিন্তু ১৬০০ সালের পর যেসব দুর্গাপূজা শুরু হয়, সেগুলো শুরু হয় রাজাদের মাধ্যমে, আর রাজারা চাইতো কয়েকদিন ব্যাপী বিরাট একটি জমজমাট উৎসব, কারণ তাদের টাকার কোনো প্রব্লেম ছিলো না ; এক্ষেত্রে মূর্তি যত বড় ও বেশি হতো উৎসবও হতো তত জমজমাট ও মানানসই; কারণ এত বড় আয়োজন করতে গেলে অনুষ্ঠানে এমনি ই একধরণের সাজ সাজ রব পড়ে যেতো, এটাই হলো সামাজিক কারণ। কিন্তু এর সাথে নিচের এই আধ্যাত্মিক কারণও আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো-

যেমন, নির্জলা একাদশীর উপবাস নামে হিন্দু শাস্ত্রে একটা উপবাসের বিধান আছে, যার একটা অন্যতম কারণ হলো, সারা বছরের উপবাসগুলো পালন করতে গিয়ে যদি নিজের অজ্ঞাতেই কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে নির্জলা উপবাস করলে তার পাপ মোচন হয়ে যায়। সেই রকম সারা বছর সকল দেব-দেবীর পূজা করা হলেও দেবী দুর্গার সাথে যদি তাদের আবারও পূজা করা হয়, তাহলে একক পূজায় যদি কোনো ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে তার পাপ, দেবতারা মাফ করবেন বলে এক সময় বিশ্বাস করা হতো।

এছাড়াও এই বহু দেবতার পূজা একসঙ্গে করার অন্য যে আধ্যাত্মিক কারণ, তা হলো- শক্তির দেবী দুর্গাপূজাকে একটি মহাশক্তির পূজায় পরিণত করা। খেয়াল করবেন এখানে রয়েছে সকল দেবতার প্রতিনিধি- শিব তো আছেই, শিবের প্রতিনিধি হিসেবে আছে স্বয়ং দুর্গা; ব্রহ্মার প্রতিনিধি হিসেবে আছে সরস্বতী; বিষ্ণুর প্রতিনিধি হিসেবে আছে লক্ষ্মী; এরপর আছে গণেশ, যিনি সকল কাজের সিদ্ধিদাতা; আছে কার্তিক, যিনি যোদ্ধার প্রতীক; প্রকৃতির সকল গাছপালার প্রতিনিধি হিসেবে আছে নবপত্রিকা, প্রাণী জগতের প্রতিনিধি হিসেবে আছে- সাপ, সিংহ, মহিষ, ময়ূর, ইঁদুর, পেঁচা, হাঁস। এছাড়াও আপনার শুনে থাকবেন যে, দুর্গা পূজা করতে গেলে বেশ্যার ঘরের মাটি লাগে, এর মানে হলো এই পূজা করতে গেলে কাউকেই ঘৃণা করা যাবে না্, সমাজের উচ্চ থেকে নীচ সকলকে নিয়েই এই পূজা করতে হবে, কেউ এখানে অবহেলিত বা ঘৃণিত নয়। এইভাবে দেবলোক এবং প্রাণী ও প্রকৃতিজগতের সকল কিছুর সমন্বয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে এক মহামিলনের মহাশক্তির পূজা।

এবার নজর দেওয়া যাক দুর্গা পূজার অন্যান্য বিষয়গুলোতে।

মহালয়া হলো সাধারণভাবে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন। কিন্তু তিথির ফেরে ২ বছর পর পর এটি কার্তিক মাসের প্রথমে গিয়ে পড়তে পারে, যে বছর দুর্গা পূজা কার্তিক মাসে গিয়ে হয়। তো যে বছর দুর্গা পূজা কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয়, তার পরের বছর মলমাস হিসেবে ৩০ দিন পুরো হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দুর্গা পূজাকে আবার আশ্বিন মাসের প্রথমে আনা হয়। একারণেই চন্দ্র ও তিথির হিসেব অনুযায়ী হিন্দুধর্মের সকল পূজা পার্বন অনুষ্ঠিত হলেও, কোনো অনুষ্ঠানের তারিখই একমাসের বেশি হেরফের হয় না। কিন্তু চন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী চললেও শুধু মলমাসের সিস্টেম না থাকার কারণে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সারাবছর ধরে ঘুরতে থাকে।

যা হোক, মহালয়া মানে আমরা সাধারণভাবে জানি যে, ভোরের বেলা রেডিও বা টিভিতে একটি অনু্ষ্ঠান, যাতে দেবী দুর্গার কাহিনীসহ চণ্ডীপাঠ উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এর সাথে আমরা হয়তো এটা অনেকেই জানি না যে, প্রকৃতপক্ষে মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু।

মহালয়া তিথির আরেক নাম পিতৃপক্ষ। সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, এই তিথিতে সকল মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে নেমে আসে। তাদের এই নেমে আসাকে বলে মহালয়, আর সেই মহালয় থেকেই মহালয়া। তাই এদিন সকালে পূর্বপুরুষদের আত্মার সদগতি ও সন্তুষ্টির জন্য নদীতে স্নান করে পূর্বপুরুষদেরকে স্মরণ করে নদীর জলেই অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। মহালয়ার তিথি শেষ হলেই শুরু হয় দেবীপক্ষ, যা চলে পূর্ণিমা পর্যন্ত। এই দেবীপক্ষেরই সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে দুর্গা পূজার মূল অনুষ্ঠান।

দুর্গা পূজার প্রধান অনু্ষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হলো কুমারী পূজা। অষ্টমী তিথিতে করা এই পূজায় দুর্গাকে কুমারী হিসেবে পূজা করা হয়। কারণ, সকলের দুর্গতি নাশকারী আশ্রয় দাত্রী হিসেবে দুর্গাকে মা বলা হলেও দুর্গা আসলে কুমারী। স্থূল দৃষ্টিতে দুর্গাকে শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হলেও আসলে দুর্গা শিবস্থিত নারী শক্তি, যার কোনো আলাদা সত্ত্বা নেই। কিন্তু দুর্গাকে আলাদা সত্ত্বা হিসেবে ধরে নেওয়ার পর, নারী জাতির একান্ত চাওয়া পুত্রের শখ পূরণ করতে দুর্গার একটি পুত্র গণেশের কল্পনা করা হয়েছে, পুরাণ মতে যাকে দুর্গা নিজেই সৃষ্টি করে; আর পরবর্তীতে এক অসুরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার পরিকল্পনায়- শিব, দুর্গাকে, অপর পুত্র, কার্তিককে দেন। মূলত দুর্গার এই দুই পুত্রলাভ কোনো সেক্সুয়াল এবং বায়োলজিক্যাল ঘটনা নয়, সেকারণে দুর্গা কুমারী ই, এজন্যই দুর্গাকে কুমারী রূপে পূজা করতে হয়।

তাছাড়াও দুর্গার যুদ্ধকালীন রূপ, যে রূপকে আমরা্ পূজা করি, দুর্গার সেই রূপ যে কুমারী তার প্রমান আছে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনীতে। যেমন- অসুর নিধনের উদ্দেশ্যে দুর্গার আবির্ভাবের পর তাকে দেখে শুম্ভ নিশুম্ভের চর- চণ্ড ও মুণ্ড, শুম্ভ নিশুম্ভকে গিয়ে বলে এমন নারী আপনাদেরই যোগ্য। এই কথা শুনে তারা অন্য এক অসুর সুগ্রীবকে দুর্গার কাছে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে, কিন্তু দুর্গা তাকে বলে,

“আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি, যে আমাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে, তাকেই আমি বিয়ে করবো, তোমার প্রভুকে গিয়ে বলো।”

এরপরই শুম্ভ নিশুম্ভ দুর্গার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করে। যুদ্ধের আগে দুর্গা যদি নিজেকে কুমারী হিসেবে বিবেচনা না করতো, তাহলে কিন্তু সে এই কথাটি এভাবে বলতে পারতো না। যা হোক, এই কুমারী পূজার মাধ্যমে পরিবারে কুমারী মেয়েদের সম্মানের বিষয়টি যেমন তুলে ধরা হয়েছে, সেই সাথে দুর্গার মতো হা্তে অস্ত্র ধরলেই যে তারা কেবল অসুর রূপী মানুষদের থেকে নিজেদের সম্মান ও কুমারীত্বকে রক্ষা করতে পারবে, সেই বার্তাটিও যুবতী মেয়েদেরকে দেওয়া হয়েছে।

দুর্গা পূজার আরেকটি প্রধান বিষয় হলো সন্ধিপূজা। কিন্তু সন্ধিপূজা আসলে কী এবং কেনো এর নাম সন্ধিপূজা, সেই ধারণা সম্ভবত অনেকেরই নেই।

শুধু দুর্গা পূজা নয়, হিন্দু ধর্মের সকল অনুষ্ঠানই তিথি নির্ভর। আমরা জানি, সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন। অষ্টমী এবং নবমী তিথির সন্ধিস্থলে এই পূজা হয় বলেই এর নাম সন্ধিপূজা। সন্ধিপূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। এর প্রথম ২৪ মিনিট অষ্টমী তিথির এবং পরের ২৪ মিনিট নবমী তিথির। এই পূজায় দুর্গাকে চামুণ্ডা রূপে পূজা করা হয়, যেটা কালীর সমগোত্রীয় দুর্গার আরেক রূপ এবং দুর্গার এই চামুণ্ডা রূপ ই হত্যা করেছিলো চণ্ড ও মুণ্ডকে। এই সন্ধি পূজা করা হয় ১৬টি উপাচার বা উপাদান দিয়ে, যার মধ্যে পশুবলির রক্ত ও মাংস দেওয়ার বিধানও রয়েছে।

অনেকেই জানেন বা শুনেছেন যে বা একটু আগে আমিও বলেছি যে, দুর্গা পূজায় বেশ্যার ঘরের মাটি লাগে, কিন্তু এর প্রকৃত উদ্দেশ্য জানেন না ব’লে হয়তো মুসলমানদের প্রশ্নের মুখে প’ড়ে বা না প’ড়ে এটা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগেছেন, এর আসল কারণটি এবার বিস্তারিতভাবে শুনুন-

আগেই বলেছি, দুর্গা পূজা হলো মহা মিলনের পূজা। এখানে যেমন সকল শক্তির সমন্বয় ঘটেছে, তেমনি সমাজের সকল স্তরের মানুষকেও এই পূজায় সমন্বয় করে সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে, এটাই দুর্গাপূজার শিক্ষা। বেশ্যাবৃত্তি রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিকোন থেকে খারাপ বলে বিবেচনা করা হলেও, সভ্য ও উন্নত সমাজের দৃষ্টিকোন থেকে এটাকে খুব একটা খারাপ বলে বিবেচনা করা হয় না। বরং কোনো মেয়ের জীবিকার যখন আর কোনো পথ থাকে না, তখন এটাকে অবলম্বন করে সে অনায়াসে টিকে থাকতে পারে; শুধু তাই নয়, এই পথকে অবলম্বন করে সে আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। যা হোক, বেশ্যাবৃত্তি বর্তমান সমাজের মতো সব যুগের সমাজেই ছিলো একটি ঘৃণিত ব্যাপার এবং হিন্দু শাস্ত্রেও এটাকে পাপ বলে বিবেচনা করা হয়েছে; কিন্তু তাই বলে এরা যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা অস্পৃশ্য নয় এবং সাধারণ মানুষদের মতো, যেকোনো ধর্মীয় উৎসবে এদের অংশগ্রহণও যে ধর্মসিদ্ধ, সেই ব্যাপারটি বোঝানোর জন্যই দুর্গা পূজায় বেশ্যার ঘরের মাটি লাগে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার এবং তাদেরকে ঘৃণা না করার শিক্ষা দেওয়া হয়। এককথায়, দুর্গা পূজা যেমন মহাশক্তির ও মহামিলনের পূজা, তেমনি সেই পূজায় সমাজের কোনো অবহেলিত জনকেই বাদ দেওয়া যাবে না বা ঘৃণা করা যাবে না, সবাইকে নিয়েই সামাজিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে, সেই শিক্ষাটিই দেওয়া হয়, এই প্রথার মাধ্যমে।

এবার নজর দিই প্রচলিত ভাষায় দেব-দেবীদের বাহনের দিকে। আগেই বলেছি দেব-দেবীদের বাহনের কোনো প্রয়োজন নেই, দেব-দেবীদের সাথে তাদের রাখার কারণ হচ্ছে, তারা প্রকাশ করে ঐ দেব-দেবী বা তাদের পূজা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য, যা জানলে মানুষের অনেক উপকার নিশ্চিত। উপরেই উল্লেখ করেছি সিংহ হলো দুর্গার ক্রোধ ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক। এই সিংহ এই তথ্য দেয় যে- দুর্গা, অসুরদের সাথে কী ভয়ংকর ধরণের যুদ্ধ করেছে। তাছাড়াও যেকোনো যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে যে সিংহের মতো শক্তি, রাগ ও ক্ষিপ্রতার দরকার, সিংহ সেই তথ্যটিও আমাদেরকে দেয়।

সাধারণভাবে বলা হয় হিমালয় পর্বত, দুর্গাকে দিয়েছিলো সিংহ। এসব ছেলেভুলানো গল্প। আগেই বলেছি পুরাণের গল্পগুলি শুধুই গল্প, বাস্তবতার সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। হিমালয় তো শুধু একটা পর্বত, এটা কিভাবে কাউকে কিছু দান করতে পারে ? মূল বিষয়গুলোকে উপলবদ্ধি করতে না পেরে পুরান রচয়িতারা বিষয়গুলোরে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য যেন-তেন ভাবে একটি করে গল্প তৈরি করে রেখে গেছে।

গনেশকে বিশ্বাস করা হয় সিদ্ধিদাতা হিসেবে এবং গনেশের সাথে আছে ইঁদুর। সিদ্ধি মানে সাকসেস বা সফলতা। তো পৃথিবীর এমন কোনো সফল ব্যক্তি নেই, যাকে নানা রকম বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যেতে হয় নি। সাফল্যের পথে বাধা বিপত্তি একটা সাধারণ ব্যাপার, সেটা মানুষ মনের জোরে দূর করতে পারে, কিন্তু কারো সাফল্যের পথে যদি থাকে ষড়যন্ত্রের জাল, তাহলে তার পক্ষে সাফল্য লাভ করা শুধু অসম্ভবই নয়, এই ষড়যন্ত্র তাকে ধ্বংস করেও ফেলতে পারে। তাই গনেশের সাথের ইঁদুর মানুষকে এই বার্তা দেয় যে, সাফল্যের পথের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং যত ষড়যন্ত্রই হোক, সাফল্য পেতে চাইলে সেই ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে ঠিক ইঁদুরের মতো; কারণ, জাল দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীকে আটকানো গেলেও ইঁদুরকে কেউ আটকাতে পারে না, ইঁদুর জালকে কেটে বের হয়ে আসতে পারেই।

এরপর আছে কার্তিকের সাথে ময়ূর এবং ময়ূরের পায়ের তলে একটি সাপ। কার্তিক হলো যুবক,
যোদ্ধা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ময়ূর, কার্তিকের এই তিনটি গুণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। মৃত্যু পর্যন্ত ময়ূরের সৌন্দর্য ও তারুণ্য কখনো নষ্ট হয় না। এছাড়াও ময়ূর সকল পাখির মধ্যে ভয়ংকর যোদ্ধা এবং পাখিদের সম্রাট। অন্যদিকে সাপ হলো গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতীক এবং যেকোনো যুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র থাকবেই। ময়ূরের পায়ের নিচে সাপের অর্থ হলো, শুধু যুদ্ধ করলেই হবে না, যুদ্ধের এই গোপন ষড়যন্ত্রকেও একইভাবে দমন করতে হবে, যেমন ময়ূর নিমিষের মধ্যে একটি সাপকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে পারে।

সরস্বতীর সাথে থাকা রাজহাঁসের এই ক্ষমতা আছে যে, দুধ ও জল মিশিয়ে দিলেও সে শুধু দুধকেই পান করতে পারে বা গ্রহন করতে পারে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী, তার রাজহংসের মাধ্যমে সমাজে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বার্তা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সব ধরণের জ্ঞানই আছে, তার মধ্য থেকে শুধু ভালোটাই গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও সরস্বতীর হাতের পুস্তক যে পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের কথা বলে সেটা তো আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই; তারপর সরস্বতীর হাতের বীণা বলে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কথা, যে শিল্প সাধনা মানুষকে সাধারণ থেকে অসাধারণ এবং মানুষের মানবতার মাপকাঠিকে এক উচ্চ মাত্রায় নিয়ে গিয়ে মানুষকে মহান করে তুলে।

লক্ষ্মীর সাথে থাকা পেঁচা, রাতের কঠিন অন্ধকারেও দেখতে পায়। অন্ধকার হলো বিপদ আপদের প্রতীক। ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর সাথে পেঁচা থেকে এই আমাদেরকে বার্তা দেয় যে, যদি টাকা পয়সা থাকে তাহলে বিপদ আপদ যত বড় আর কঠিনই হোক না কেনো, রাতের আঁধার ভেদ করে পেঁচা যেমন তার পথ দেখতে পায়, তেমনি ধন-সম্পদের জোরে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি পথ খুঁজে পাবেই এবং তা থেকে উদ্ধার পাবেই। এজন্যই হিন্দু শাস্ত্রে দারিদ্রতাকে মহাপাপ বলা হয়েছে; কারণ, যে ব্যক্তি দরিদ্র অর্থাৎ অর্থ বিত্তহীন, তার সামনে সবই অন্ধকার। পেঁচার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো গোপনীয়তা, কেননা, সে গোপন থাকার কারণেই দিনের বেলা বের হয় না, লক্ষ্মীর সাথে পেঁচা থেকে মানুষকে এই বার্তা দেয় যে অর্জিত ধন-সম্পদকে রাখতে হবে গোপনে, না হলে সেই ধন-সম্পদ বা অর্থ নানা বিপত্তির সৃষ্টি করবে, তখন অর্থ হয়ে যাবে অনর্থ। এজন্যই প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে অর্থই অনর্থের মূল।

এবার জেনে নেওয়া যাক দুর্গা এবং তার পূজা সংক্রান্ত কিছু ইতিহাস।

ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির মূলত একটি দুর্গা মন্দির। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে অর্থাৎ ১১০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে বাংলার সেন বংশের কোন এক রাজা, এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি দুর্গা সদৃশ মূর্তি খুঁজে পান, তারপর তারা সেখানেই একটি মন্দির বানিয়ে সেই মূর্তি স্থাপন করেন এবং খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে দেবীর এই মূর্তির নাম ঢাকেশ্বরী। সেই নাম অনুযায়ীই এই মন্দিরের নাম হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং পরবর্তীতে এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃত হতে শুরু করে একটি নগর বা জনপদ, আস্তে আস্তে যার নাম হয় ঢাকা। একারণেই ঢাকেশ্বরী শব্দের সন্ধি বিচ্ছেদ ঢাকা + ঈশ্বরী। এই তথ্য প্রমান করে যে ঢাকেশ্বরী থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি। শুধু তাই নয়, ঢাকার বর্তমান মহাখালি এলাকায় কোনো এক সময় ছিলো একটি কালী মন্দির, যার নাম ছিলো মহাকালী।  মুসলিম শাসনামলে এই এলাকার হিন্দু জনবসতি বিলুপ্ত হয় এবং সেই সাথে সেই কালী মন্দিরটিও বিলুপ্ত হয় এবং উচ্চারণগত সুবিধার জন্য মহাকালী আস্তে আস্তে পরিণত হয় মহাখালীতে। এছাড়াও ঢাকার রামপুরা এলাকার নামের উৎপত্তি হিন্দু দেবতা ‘রামচন্দ্র’ এর নাম থেকে।

যা হোক, ১২০০ সালের আগে থেকেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজা হতে থা্কলেও সম্ভবত জঙ্গলে ঘেরা থাকার কারণে এই পূজার ব্যাপক জনশ্রুতি ছিলো না। এজন্য বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম দুর্গাপূজা বলা হয় রাজশাহী জেলার তাহেরপুর থানার রাজা কংসনারায়নের পূজাকে, যেটা শুরু হয় মোটামুটি ১৬০০ সালের দিকে। বর্তমানে দুর্গা পূজা হয় বাংলাদেশ, নেপা্ল এবং ভারতের- পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, মনিপুর ও ত্রিপুরায়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে দুর্গাপূজা নবরাত্র হিসেবে উদযাপতি হয়। এছাড়াও মূলত প্রবাসী বাঙ্গালি হিন্দুরা বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে দুর্গা পূজা করে থাকে।

বারোয়ারি নামে এক ধরণের পূজা হিন্দু সমাজে প্রচলিত আছে, যাতে এলাকার সকল হিন্দুর অংশ গ্রহন থাকে। ১৬০০ সালের দিকে রাজারা যখন দুর্গাপূজা শুরু করে, তার কিছু পর পাড়া বা গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবা্রগুলো মিলে এই পূজা শুরু করে, এই বারোয়ারি নামের উৎপত্তি হয়েছিলো এভাবে, রাজাদের বাইরে প্রথম যারা দুর্গা পূজা শুরু করে তারা ছিলো পরস্পরের ১২ বন্ধু, বন্ধু শব্দের হিন্দি ইয়ার, কিন্তু ইয়ার হিন্দি শব্দ হলেও বাংলায় ছিলো এবং এখনও আছে এর ব্যাপক ব্যবহার, এইভাবে বার+ইয়ার মিলিয়ে হয় বারোয়ারি। দুর্গা পূজার খরচ অনেক বেশি ছিলো বলে রাজা বা জমিদার ছাড়া কারো একার পক্ষে এটা বহন করা ছিলো কষ্টসাধ্য, এই সমস্যা সমাধানেই উৎপত্তি হয় বারোয়ারি পূজার, প্রথমে ১২ জন শুরু করলেও, এখন এটার সদস্য সংখ্যার কোনো লিমিট নেই। এই ধরণের পূজা এখন সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত হলেও, সাধারণ লোকের মুখে মুখে এটা এখনও বারোয়ারি পূজা।

শুরুতে দুর্গা পূজা প্রচলিত ছিলো চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে, যা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত; কিন্তু পরবর্তীতে, মধ্যযুগে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’ যখন রামায়ণ অনুবাদ করে, তখন মূল সংস্কৃত রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গা পূজা করার কোনো উল্লেখ না থাকলেও, যেহেতু কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম- পুরাণে রামের দুর্গা পূজার কথা উল্লেখ আছে, সেহেতু কৃত্তিবাস তার বাংলা রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গা পূজার কথা উল্লেখ করে এবং সেই কৃত্তিবাসী রামায়ন প’ড়ে বাঙ্গালিরা শুরু করে শরৎ কালে দুর্গা পূজা, যা শারদীয় উৎসব নামে বর্তমানে পরিচিত এবং সকল হিন্দুই যেহেতু মনে করে যে তারা রামের মতোই মহাদুর্গতিতে আছে, তাই দুর্গার এই অকাল বোধন এখন হিন্দু সমাজে ভীষণ জনপ্রিয়।

শেষ কথা হলো, সবাই মোটামুটি এটা জানে এবং বোঝে যে দুর্গা পূজার মূল উদ্দেশ্য হলো অশুভ শক্তিকে বিনাশ করা। কিন্তু প্রায় কোনো হিন্দুই এটা বোঝে না যে, বর্তমানে এই অশুভ শক্তিটা কে বা কারা ? পুরাণের কাহিনীতে অশুভ শক্তি হিসেবে অসুরদের বোঝানো হয়েছে, কিন্তু এখন তো আর সেই ধরণের অসুর নাই, তাহলে আপনি কোন অসুরদেরকে বিনাশ করার জন্য দুর্গার পূজা করছেন ?

অসুর পৃথিবীতে সব সময় ছিলো এখনও আছে। যারা, আপনার বাড়ির মেয়েদের দিকে কুনজর দেয়, আপনার সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ায় এবং এগুলো পাওয়ার জন্য যারা গোপনে ষড়যন্ত্র করে এবং আপনাকে হত্যার চেষ্টা করে, তারাই অসুর। এরকম অসুর আপনার আশেপাশে অবশ্যই আছে, দুর্গাপূজা করার আগে এদেরকে আগে চিনুন। পুরাণের রূপ পরিবর্তনকারী ভয়ংকর সব রাবন জাতীয় অসুরদেরকে বধ করার জন্য আপনাকে দুর্গা পূজা করতে বলা হয় নি, আপনার আশেপাশেই যেসব সব মডার্ন অসুর রয়েছে, যাদের চোখ আপনার বাড়ির মেয়ে ও আপনার ধন-সম্পত্তির উপর, তারাই এ যুগের অশুভ শক্তি। দুর্গা পূজা থেকে শিক্ষা নিয়ে, দৈহিক ও মানসিকভাবে এই সব অশুভ শক্তিকে দমন করার ক্ষমতা যদি আপনি অর্জন করতে পারেন, তাহলেই সার্থক আপনার পূজা-প্রার্থনা, অন্যথায় দুর্গাপূজা আপনার জন্য শুধুই একটি অর্থক্ষয়ী বিনোদনী অনু্ষ্ঠান মাত্র।

জয় মা দুর্গা

জয় শ্রীরাম। জয় শ্রীকৃষ্ণ।
২টি মন্তব্য on "দুর্গা পূজা কী ও কেনো করা হয়?"