Ads

সনাতন জ্ঞান

সনাতন হিন্দু ধর্মকে জানুন কীতাব পড়ুন শিখুন এবং প্রশ্ন করুন. বিনামূল্যে সকল বইগুলো অনলিনেই সরাসরি পড়তে পারবেন অন্যদের পড়ার জন্য শেয়ার করবেন, নতুন পোস্ট পেতে ফাসেবুকে লাইক দিয়ে রাখুন |

মূর্তি পূজা কি? মূর্তি পূজা কেন করা হয়? ঈশ্বর কে? দেবদেবী কে? ঈশ্বর ও দেব দেবীর মধ্যে পার্থক্য কি?

মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
আমরা কি সঠিক ভাবে এর উত্তর দিতে পারি, আর এজন্য আমরা অন্যের কাছে হিন্দুধর্ম কে হাসির পাত্র বানাই।
অনেকেই সনাতন ধর্মের মূর্তি পূজা নিয়ে প্রশ্ন করে।এ প্রশ্ন যে শুধু অন্য ধর্মের লোকেরা করে তাই নয় বরং অনেক সনাতন ধর্মালম্বীরাও করে।
আজ তাই আপনাদের কে মূর্তি পূজা কি এবং কেন তা কেনোই বা করা হয় তাই সনাতন দর্শনের আলোকে মাধ্যমে তুলে ধরব।
মূর্তি পূজার স্বরূপ জানতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে ঈশ্বর ও দেবতা বলতে সনাতন দর্শনে কি বলা হয়েছে
ঈশ্বর ও দেবতা
প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নাই বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা।আমাদের প্রাচীন ঋষিগন বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই(নিরাকার ব্রহ্ম)তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপ ধারন করতে পারেন কারণ তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী।
ঋকবেদে বলা আছে ঈশ্বর “একমেবাদ্বিতীয়ম” – ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।ঈশ্বর বা ব্রহ্ম(নিরাকার ব্রহ্ম)।ঈশ্বর সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে তিনি “অবাংমনসগোচর” অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা(বাক), মন বা চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, তিনি বাহ্য জগতের অতীত। ঈশ্বর সম্পর্কে আরো বলা আছে-
১. ছান্দেগ্য উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ২ নম্বর পরিচ্ছেদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-
“একাম এবাদ্বিতীইয়ম”
অর্থ- “স্রষ্টা মাত্র একজনই দ্বিতীয় কেউ নেই”
২. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-
“না চস্য কসুজ জানিত না কধিপহ”
অর্থ- “সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কোন বাবা মা নেই, তাঁর কোন প্রভু নেই,
তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই”
৩. “একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি” (ঋকবেদ-১/৬৪/৪৬) অর্থাৎ “সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে ডেকে থাকেন”
৪. যজুবেদের ৩২ নম্বর অধ্যায়ের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-
“ন তস্য প্রতিমা আস্তি”
অর্থ- “সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই”
৫. যজুবেদের ৪০ নম্বর অধ্যায়ের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে-
“সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিরাকার ও পবিত্র”
৬. “একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি” (ঋকবেদ-১/১১৪/৫) অর্থাৎ “সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে”
৭. “দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত” (ঋকবেদ-১০/৭২/৭) অর্থাৎ “দেবতারও পূর্বে সেই অব্যাক্ত(ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগতে উৎপন্ন লাভ করেছে”
৮. যজুবেদের ৪০.১ “এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে।যিনি কখনই অন্যায় করে না অথবা অন্যায় ভাবে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা রাখে না”
৯. ঋগবেদ ১০.৪৮.৫ “ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেন। তিনি অপরাজেয় এবং মৃত্যুহীনও তিনি এই জগতের সৃষ্টিকারী”
১০. যজুর্বেদ সংহিতা -৩২.১১ “ঈশ্বর যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত”
১১. ঋগবেদ সংহিতা -১০.৪৮.১ “ঈশ্বর যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন”
১২. “ঈশ্বর সকল ভূতপ্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন” – শ্রীমদভগবদগীতা-১৮/৬১
আরো বলা আছে, তবে লেখা বড় হয়ে যাবে বলে, সবটা আর বল্লাম না।
ঈশ্বর এক কিন্তু দেবদেবী অনেক। তাহলে দেব দেবী কারা ?
মনে রাখতে হবে দেবদেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণা অর্থাৎ জগতের সব গুনের(Quality) আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুনও কারণ সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর চাইলেই যে কো্নো গুনের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুনের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন। দেব দেবীগন সেই ঈশ্বরের এই সগুনের প্রকাশ।অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুনের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যে কোন রূপে সাকার হতে পারেন, আমাদের সামনেই কারণ, তিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। যদি আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক।
তাই, ঈশ্বরের শক্তির সগুন রূপ- কালী, নবদুর্গা, কার্তিক ইত্যাদি।
বিদ্যা-সিদ্ধির সগুন রূপ- সরস্বতী, গণেশ ইত্যাদি।
ঐশ্বর্যের সগুন রূপ- লক্ষ্মী, কূবের ইত্যাদি।
মৃত্যুর সগুন রূপ- কালভৈরব, ভূতনাথ, যম ইত্যাদি।
তেমনি ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা (দেব)
যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু (দেব)
আর প্রলয়রূপে শিব (দেব)
তিনি যখন আলোপ্রদান করেন তখন তিনি- সূর্য ও চন্দ্র
তিনি আবার পঞ্চ ভূত- ক্ষিতি, অপ, মরুৎ, বোম, তেজ
এই ভাবে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুনের প্রকাশ হয়।
ঐতরেয় উপনিষদ ১.১ তে বলা আছে-
“সৃস্টির পূর্বে একমাত্র পরমআত্মা ছিল এবং সবকিছু ঐ পরমআত্মার মধ্যে স্থিত ছিল, সেই সময় দৃশ্যমান কিছুই ছিলনা। তখন পরমআত্মা স্বয়ং চিন্তা করলেন, আমি, আমি হইতে এই জগৎ নির্মাণ করব”
এর জন্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই এক ঈশ্বরের অংশ। আর এই এক-একটি অংশ হল এক-একটি দেবদেবী। যদি আমরা ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের ছবিটি দেখী, তাহলে খুব সহজে এটা বুঝে যাব। শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের যতকটা মস্তক আছে, প্রতিটি মস্তক এক একটি দেবতা প্রকাশ করে অর্থাৎ  ঈশ্বরের এক একটি গুনের প্রকাশ করে। এবার প্রশ্ন তাহলে কয়টা মস্তক ছিল ? অর্জুন এখানে বলেছিল শ্রী কৃষ্ণের বিশ্বরূপের কোনো সীমা ছিল না অর্থ্যাৎ তার শুরু আর শেষ ছিলনা অর্থ্যাৎ অসীম, এটাই হল ঈশ্বরের নির্গুণা হবার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কারণ ঈশ্বরের গুনের সংখ্যা অসীম অর্থ্যাৎ  নির্গুণা।
এজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরই ব্রহ্মা, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই শিব এইভাবে।
তাহলে আমারা এখন বুঝতে পারছি দেবদেবী অনেক হতে পারে কিন্তু ঈশ্বর এক এবং দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ। এখানে ২ টি দেবের উদাহরণ দিচ্ছি ব্যাপারটা ভালো ভাবে বোঝার জন্য-
(১)বিষ্ণু , বিষ্-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ ব্যাপ্তি, অর্থ্যাৎ “সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন যিনি” এক কথাই “সর্ব্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ” মানে সমগ্র জগৎ বিষ্ণুময়। এবার আমার প্রশ্ন কে সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন?  উওর ভগবান বা ঈশ্বর , ঋগবেদ সংহিতা -১০.৪৮.১ “ভগবান যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন”।
(২)শিব, শী-ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ শয়ন, অর্থ্যাৎ যিনি সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত। এবার আমার প্রশ্ন কে সবকিছুর মধ্যে শায়িত বা অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন?  উওর ভগবান বা ঈশ্বর , যজুর্বেদ সংহিতা -৩২.১১ “ভগবান যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত”।
তাই হিন্দুরা বহু দেবোপাসক(বস্তুত দেবোপাসনা ঈশ্বর উপাসনাই) হতে পারে তবে বহু ঈশ্বরবাদী নন।
এতক্ষন আপনাদেরকে বললাম ঈশ্বর আর দেবতার পার্থক্য। এখন বলব তাহলে আমরা কেন এ সকল দেব দেবীগণের মূর্তি পূজা করি।
মূর্তি পূজার রহস্য ?
মানুষের মন স্বভাবতই চঞ্চল।পার্থিব জগতে আমাদের চঞ্চল মন নানা কামনা বাসনা দিয়ে আবদ্ধ। আমরা চাইলেই এই কামনা বাসনা বা কোন কিছু পাবার আকাংক্ষা থেকে মুক্ত হতে পারি না।(ধরুন একজন শিক্ষার্থী তাঁর শিক্ষা জীবনের বাসনা থাকে পরীক্ষায় প্রথম হউয়া।এ জন্য সে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে।) তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা, স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই সগুন ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপের মাধ্যমে।মনে রাখতে হবে আমরা কখনই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতা কে আমদের সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারব না। বরং সর্বগুণময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুনকেই বুঝতে পারব।আর এ রকম এক একটি গুনকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোন দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারব।আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুনের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গনিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরা। আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই হয়ত আমরা গনিতের সমস্যার উত্তর পেয়ে যাই। অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা কোন কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করি। কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হল যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই কিন্তু অবস্থিতি আছে – যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপতে পারি। আবার ধরুন ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করি এটা পৃথিবী আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলি এটা লন্ডন, এটা ঢাকা এটা জাপান। কিন্তু ঐ গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী?  অথচ ওগুলো দেখেই আমরা পৃথিবী চিনছি।
তেমনি মূর্তির রূপ কল্পনা বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুন সম্পর্কে ধারনা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌছাতে সাহায্য করে। হিন্দু ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাড়িয়ে সত্য উত্তরণই পূজার সার্থকতা। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে।নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদি। এজন্য গীতায় বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন।তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। কিন্তু সাকারবাদিদের সাকার ভগবানের উপর মনস্থির করা তুলনামূলক ভাবে সহজ। এই সাকার ভগবানের চাহিদা মেটাই “মূর্তি” গুলো। এছাড়া এই মূর্তিগুলি আমাদের পরম ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কার্যকারীতা সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ২ টি উদাহরণ দিচ্ছি ভালো ভাবে বোঝার জন্য –
(১)ব্রহ্মার ৪টি মাথা কেনো?  কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নাম ব্রহ্মা অর্থ্যাৎ স্রস্টা যিনি ৪টি বেদের উৎপত্তি করেছিলেন , এই গুনটিকে বোঝাবার জন্য ব্রহ্মার মূর্তিতে ৪টি মস্তক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্বে বেদ একটি ছিল পরে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ঐ একটি বেদ কে, তাদের গুরুত্ব অনুসারে বিভাজন করে ৪টি বেদে পরিণত করেন, তাই বর্তমান ধারণা অনুসারে ব্রহ্মার ৪টি মাথা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই ৪টি মাথা তো আর সত্য নয়, এই ৪টি মাথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ৪টি বেদের ব্যাপারে।
(২)শিবের তিনটি চোখ কেনো? কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নামে ৩টি গুণ-সত্ত্বঃ,রজোঃ ও তমোঃ প্রকাশ হচ্ছে। এর জন্য শিবের মূর্তিতে তিনটি চোখ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভগবান তো নির্গুণা, এখানে তিনটি চোখ এটাই বোঝাচ্ছে পরম ভগবান এই গোটা জগৎ কে এই ত্রিগুণ-সত্ত্বঃ, রজোঃ ও তমোঃ দিয়ে নির্মান করেছেন। অর্থ্যাৎ এই সম্পূর্ণ জগৎ তিনটি গুনের আধারে তৈরী।
তবে কি হিন্দুরা পৌত্তলিক ?
অন্য ধর্মের লোকেরা সনাতন দর্শন সম্পর্কে না জেনেই মূর্তি পূজা দেখে মন্তব্য করে বসেন হিন্দুরা পৌত্তলিক। কিন্তু সঠিক দর্শন জানলে তাঁদের এ ভুল ধারনা ভাঙবে।আগেই বলেছি আমাদের দেবতা অনেক কিন্তু ঈশ্বর এক।ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নেই। দেবতারা হলেন ঈশ্বরের এক একটি রূপের বা গুনের প্রকাশ।মূর্তি বা প্রতিমা হল সে সকল গুনের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। সব ধর্মেই এমন রূপকল্প, চিহ্ন বা প্রতীক আছে, যা তাঁদের কাছে পবিত্র। যেমন ধরুন
খৃস্টানদের গির্জায় মাতা মেরী বা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিমা থাকে, যার সামনে তাঁরা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে।
আবার মুসলিমরা কাবাশরীফের কালো পাথরকে পবিত্র মনে করে চুম্বন করে কিংবা কোন কাগজে আরবিতে আল্লাহ লেখা থাকলে তাকে সম্মান দেয়, তাকে যেখানে সেখানে ফেলে দেয় না।
তাহলে ঐ কাগজখানা কি আল্লাহ নিজে?  না । কিন্তু তারপরও তাকে সম্মান করে কারণ তা আল্লাহ নাম, ওটা দেখে আল্লাহর কথা মনে আসে, তার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঠিক এমনি হয়। কেউ কেউ শুন্যপানে চেয়ে প্রার্থনা করে। তাহলে কি ঐ শুন্যপানে ঈশ্বরের বসতি ? আসলে তা নয়। আমি আগে বলেছি ঈশ্বর সর্বস্থানে বিরাজমান। এটা তাদের স্বীয় বিশ্বাস, যে আকাশে ঈশ্বরের বসতি। এভাবে যদি চিন্তা করা হয়,তাহলে দেখা যায় জগতের সবাই পৌত্তলিক।
এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন।
পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ তখন আলোয়ারের মহারাজের অতিথি । আলোয়ার রাজ কথা প্রসঙ্গে স্বামীজিকে জানালেন যে মূর্তি পূজায় তিনি বিশ্বাস করেননা । স্বামীজি একথা শুনে মহারাজার একটি চিত্র আনতে বললেন এবং রাজার দেওয়ানকে বললেন ওই ছবির উপর থুথু ফেলতে ।সমস্ত রাজসভা নিঃশব্দে এই দৃশ্য দেখতে লাগল । দেওয়ান স্বামিজির নির্দেশ পালনে অসমর্থ হলেন, তখন স্বামীজি বললেন, এই ছবি তো একটি রং করা কাগজ মাত্র, এই ছবি তো আর রাজা নয়, তাহলে এর উপর থুথু ফেলতে অসুবিধা কোথায় ? স্বামীজির বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও দেওয়ান যখন রাজার ছবিতে থুথু ফেলতে পারলেননা।
তখন স্বামীজি রাজাকে বুঝিয়ে বললেন, ফটোগ্রাফ তো একটি জড়বস্তু, একখণ্ড রং করা কাগজ মাত্র । তবু ওই ছবিটি আসল মানুষটিকে মনে করিয়ে দেয় । ছবিটির দিকে দেখলে আমরা ভাবিনা, যে নিছক কোনও রং করা কাগজ দেখছি । ঠিক তেমনই আমরা যখন মাটির মূর্তি পূজা করি আমরা মনে করি স্বয়ং ভগবানকেই পূজা করছি । আমরা সে সময় কখনও মনে করিনা আমরা কোনও জড় মূর্তি বা খড় বা মাটির উপাসনা করছি, আমরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র প্রতীক মনে করি এর বেশি কিছু নয়। এজন্য পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগন মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় দেবতাগন ঐ প্রতিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেন।যদি মন্ত্রটির সংস্কৃত কে বাংলা করেন তো বুঝবেন মন্ত্রে কেবল পরম ঈশ্বরের ঐ সাকার গুণটিকে(দেবতা) বিভিন্ন ভাবে অনুরোধ করছে, ঐ মাটির মূর্তিতে স্থাপন হবার জন্য।
আবার কাঠমাটির প্রতিমা যে ঐ সকল দেবতা নয়, তার প্রমান মেলে পূজার পর প্রতিমা গুলোকে জলে বিসর্জন দিয়ে, যদি প্রতিমাকেই ঐ সকল দেবতা মনে করা হত তাহলে নিশ্চয় কেউ তা জলে বিসর্জন দিত না!
তাই হিন্দুরা দেবমূর্তি পুতুল নয়, তা চিন্ময় ভগবানেরই প্রতীক। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদি।
এজন্য স্বামী বিবেকানন্দের বলেছেন- “পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ মাটি দিয়ে গড়া, মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা’’
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কেন তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের পূজা না করে সাকার ঈশ্বরের পূজা করি?
জাগতিক মোহ থেকে সাকার পূজা করা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি যে বিদ্যা চায়, তাহলে সে সরস্বতী দেবীর প্রার্থনা করে,  যে অর্থ চায় সে লক্ষ্মী দেবীর প্রার্থনা করে, তেমনি যে বিভিন্ন বাধা বিপত্তি থেকে উদ্ধার চায় সে কালী পূজা করে। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২০
শ্লোক-
“কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তাং তাং নিয়মমাস্থায় প্রকৃ্ত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।”
অনুবাদ-
“জড় কামনা-বাসনায় দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তারা অন্য দেবদেবতার শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে”
মানুষ মাত্রই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত তাই তারা মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করছে ও করবেও ।দেবতার রূপ ও গুন মানুষের বিচিত্র রুচিকে তৃপ্ত করে ও চঞ্চল মনকে অচঞ্চল করতে সহায়তা করে।
উদাহরণ –
একমাত্র মন্দির বা উপাসনালয়ে গেলে মনে পবিত্রতা আসে, মন প্রাশান্ত হয়,মনে ভক্তি জেগে ওঠে।অথচ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।তাহলে কেন শুধুমাত্র মন্দিরে গেলেই মনে বেশি ভক্তিভাব আসে।আসলে জাগতিক মোহে আবদ্ধ হয়ে আমরা ঈশ্বরের এই সর্ববিরাজমানতা ভুলে যাই।
একই কথা মুসলিমদের ক্ষেত্র প্রয়োজ্য, তারাও মসজিত যাই, দরগাই যাই, মক্কাই যাই, মদিনাই যাই তাহলে তারাও কি সবাই পৌত্তলিক ? বাড়িতে দেখবেন কাবাশরীফের বা মদিনাশরীফের ছবি টাঙিয়ে বা আরবি তে আল্ল লেখা কাগজের টুকরো, তাতে ফুলের মালা চড়িয়ে রেখেছে।
এখানে সেই একই কথা ঐ সব স্থানে গেলে তাদের মনে পবিত্রতা আসে, মন প্রাশান্ত হয়, মনে ভক্তি জেগে ওঠে, ওটা দেখে আল্লাহর কথা মনে আসে, তার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়,মনকে স্থির করতে সাহায্য করে ।অথচ তারা এটাও ভালোভাবে জানে আল্লাহর সর্বত্র বিরাজমান।
তারাও তো মসজিতের ভিতর পশ্চিমমুখী “মাজার” নির্মাণ করে, আবার ঐ “মাজার” তে দামি চাদর দিয়ে মুড়ে দেয়, ফুল দেয়, তাহলে তারাও কি সবাই “মাজার” পূজা করে ?
এখানে, “মাজার” একটি প্রতীক “হজরত মুহম্মদের” যে তাদেরর নামাজ আদায় করা শিখিয়ে ছিল। এটাও তাদের বিশ্বাস “আমি হজরত মুহম্মদ কে সাক্ষী রেখে, তার শেখানো রাস্তায় নামাজ আদায় করছি”। এই হল মসজিতে “মাজার” এর কার্যকারীতা, আবার দেখবেন দরগাই গিয়ে পীর এর “মাজার” তে ফুল দিচ্ছে, চাদর দিচ্ছে, দোয়া চাইছে !
তাহলে ঐ “মাজার” টি কি আল্লা ? না, এখানে ঐ পীর কে স্মরন করার জন্য এগুলি ওরা করে থাকে, ঠিক হিন্দুদের ক্ষেত্রে সেই একই ব্যাপার, যা আগে ব্যাখা করেছি।
বস্তুত মুসলিমদের কার্যকারিতাও সাকারবাদির ন্যায় কিন্তু কুরাণ অনুসারে তাদের নিরাকারবাদি হবার কথাছিল, কিন্তু তারা এই কথাটা নিজের মুখে স্বীকার করবে না।
আর যারা সবস্থানে ঈশ্বরের এই অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন তারাই নিরাকার উপাসনার যোগ্য। তেমনি একটি ছোট বাচ্চাকে কিংবা কোন অজ্ঞ ব্যক্তিকে নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে ধারনা দিবেন সে বুঝবে না! বরং সে সহজে বুঝবে সাকার দেবতারূপ ঈশ্বরকে।এই সাকার রূপের প্রতিমা দেখে সহজেই বুঝতে শিখবে ঈশ্বরের গুনের কথা, শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে ।এভাবে শুরুতে সাকার উপাসনার মধ্য দিয়েই নিরাকার উপাসনার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় আমাদের। তাই কেউ যদি এক লাফে নিরাকারবাদি হতে চাই, তাহলে তাকে যথেস্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দার্শনিক জ্ঞান সম্পন্না হতে হবে। তবে সব কিছুই যেহেতু সেই অসীমেরই অংশ তাই শ্রদ্ধা সহকারে দেবতার পুজাও পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা। এজন্য সনাতন সংস্কৃতিতে দেখা যায় শুধু মাত্র দেবতা নয় উদ্ভিদ, উপকারী প্রাণী এমনকি মনুষ্য পুজাও করে থাকেন অনেকে, এছাড়াও উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীদেরও অনেক সময় উপকারীতা ব্যাক্ত করার জন্য অথবা পরিবেশের উপকারীতা ব্যাক্ত করার জন্য, তাদের কেও পূজা করা হয়ে থাকে।এটা যেমন এক দিক দিয়ে পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা ও আরেক দিক দিয়ে উপকারীতা ব্যাক্ত করার একটি পদ্ধতি, এইছাড়া এতে অনেক পৌরাণিক ব্যাখা আছে ।
তবে দেবোপাসনায় কাম্য বস্তু লাভ হলেও ঈশ্বর লাভ হয় না।শুধুমাত্র পরম ঈশ্বরের উপাসনাতেই ঈশ্বর লাভ হয়। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ
বলেছেন- শ্রীমদভগবদগীতা ৯.২৫
শ্লোক-
যান্তি দেবব্রতা দেবান পিতৃন যান্তি পিতৃব্রতাঃ ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদযাজিনোহপি মাম।।
অনুবাদ-
“দেবতাদের উপাসকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হবে, পিতৃপুরুষদের উপাসকেরা পিতৃলোক
লাভ করে, ভূত-প্রেত আদির উপাসকেরা ভূতলোক লাভ করে এবং আমার (ঈশ্বরের)উপাসকেরা আমাকেই(ঈশ্বরকে) লাভ করে”
সরল অর্থ-
হে অর্জুন! দেবোপাসকগন দেবগনকে প্রাপ্ত হয়। দেবগন পরিবর্তিত সত্তা।
তারা নিজেদের সদকর্মানুসারে জীবন অতিবাহিত করে। পিতৃগনের পূজকগন পিতৃগনকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ অতীতের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকে।ভূতোপাসকগন ভূত হন অর্থাৎ জীবদেহধারণ করেন এবং আমার (ঈশ্বরের)ভক্ত আমাকেই(ঈশ্বরকে) লাভ করেন।
এখানে মূর্তি বা ভগবত বিগ্রহ প্রতীক বটে তবে মূর্তি পূজা সম্পর্কে এটাই শেষ কথা নয়। সাধনা যাত্রার প্রারম্ভে শ্রীমূর্তি হতে পারে কিন্তু সাধনার পরিনতিতে উহা চিন্ময় সত্তা। প্রতীক রুপটি চিন্ময় রুপে পরিনতি হলেই পূজা সার্থক হয়।যিনি একদিন ছিলেন অপরিচিত লোক – তারই সঙ্গে বহু মেলামেশার পর যেমন তিনি হয়ে ওঠেন পরম বন্ধু – সেইরুপ, প্রতীক রূপে যে মূর্তির হয় প্রতিষ্ঠা, ভক্তের অর্চনার ফলে তিনিই হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ভগবান। আচার্য রামানুজের কথায় যা হল “অরচ্চাবতার” এবং এই ভাবে সেই ভক্ত শ্রীমূর্তি থেকে পরম চিন্ময় সত্তা কে বোঝে এবং একসময় “সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভুতি লাভ করে” অর্থাৎ “পরম ঈশ্বর কে লাভ করে” অর্থাৎ  “স্ব-আত্মা সাথে পরমআত্মার সংযোগ” । শূধুমাত্র এই অংশটুকু সংঘটিত হতে সময় লাগতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক মাস বা কয়েক বছর আবার এই জন্মেও না হতে পারে। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিজের উপর। এই প্রসঙ্গে আচার্য রামানুজের একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা বুঝতে পারবেন।
আচার্য রামানুজের কাছে একদিন এক মূর্তি পুজায় আস্থাহীন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হন।তিনি আচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রহ্ম বিশ্ব ব্যাপী, তাকে পূজা করার জন্য আপনি ছোট ছোট কতগুলি পিতলের মূর্তি রেখেছেন কেন? আচার্য বললেন, আমার ধুনি জ্বালাবার জন্য আগুনের দরকার, আপনি গ্রাম হতে আমাকে আগুন এনে দিন , তারপর আপনার প্রশ্নের জবাব দিব।
ঐ লোকটি একখানা কাঠে আগুণ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আচার্য তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এক খণ্ড দগ্ধ কাঠ এনেছেন কেন? যা বলেছি তাই আনুন। আগুন বলেছি আগুন আনুন। আগুন সকল বস্তুর মধ্যেই আছে। আপনার হাত ঘষে দেখুন, হাতের মধ্যেও আগুন আছে। আপনি আমার জন্য একটু খাটি আগুন আনুন। পোড়া কাষ্ঠ চাই না।
আচার্যের কথা শুনে লোকটি বললেন, অগ্নি সব বস্তুর মধ্যেই আছে কিন্তু আপনার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখি না।
তখন আচার্য বললেন, সকল বস্তুর মধ্যে নিহিত অগ্নিকে আমার নিকট আনতে হলে কাষ্ঠ ছাড়া উপায় দেখেন না- আমিও সেই রূপ সর্বভুতস্থ সর্বব্যাপী পরম ব্রহ্মকে আমার নিকটতম আনতে চাইলে, মূর্তিকে আরোপ ছাড়া উপায় দেখি না। আপনার হাতের কাষ্ঠ খানা আগে ছিল কাষ্ঠ কিন্তু তাতে অগ্নি ধরাবার পর তা হয়ে উঠেছে অগ্নি, তেমনি আমার নিকটস্থ এই ঠাকুরটি এক সময় ছিলেন পিতল নির্মিত মূর্তি এখন সেটি চিন্ময় ব্রহ্ম। ইহা সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।নারায়ণ যেমন অযোধ্যায় এসেছিলেন রাম রূপে, তিনি আজ আমার দুয়ারে এসেছেন ‘অরচ্চাবতার’ রূপে। আচার্যের উক্তিটি জিজ্ঞাসু ব্যক্তিটির সকল সংশয় দূর করে দিল।
তাহলে কি ঈশ্বর আমাদের মূর্তিপূজা্র অনুমতি দিয়েছে ?
শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২০
“কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তাং তাং নিয়মমাস্থায় প্রকৃ্ত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।”
অনুবাদ-
“জড় কামনা-বাসনায় দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তারা অন্য দেবদেবতার শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে”
আমি আগেও বলেছি মানুষ মাত্রই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত তাই তারা মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করছে ও করবেও অর্থাৎ সাকারবাদি। কিন্তু যাদের মস্তিস্ক এই জড় কামনা-বাসনা দ্বারা জড়িত নয় তারা কিন্তু মূর্তি নির্মিত দেবতাদের উপাসনা করবে না অর্থাৎ নিরাকারবাদি।তারা “সর্বভূতে ঈশ্বরের অনুভুতি লাভ করে”। আর আগেও বলেছি নিরাকারবাদি হতে গেলে তাকে যথেস্ট আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্না হতে হবে, যেটা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এক লাফে, কোনো দিনও সম্ভব নয়। তাই সাকারবাদি থেকে নিরাকারবাদির দিকে যেতে হবে।
এরপর
শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২১ তে বলা হয়েছে-
“যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি ।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম ।।”
“পরমাত্মারূপে আমি সকলের হৃদইয়ে বিরাজ করি। যখনই কেউ দেবতাদের পূজা করেতে ইচ্ছা করে, তখনই আমি সেই সেই ভক্তের তাতেই অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি”
অর্থ্যাৎ-
ভগবান প্রত্যেককেই স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই কেউ যদি জড় সুখভোগ করার জন্য কোন দেবতার পূজা করতে চাই, তখন সকলের অন্তরে পরমাত্মারূপে বিরাজমান পরমেশ্বর ভগবান তাদের সেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন। সমস্ত জীবের পরম পিতা ভগবান কখনও তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না, পক্ষান্তরে তিনি তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দান করেন।
এরপর
শ্রীমদভগবদগীতা ৭.২২ তে বলা হয়েছে-
স তয়া স্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে ।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান হি তান ।।
সেই ব্যাক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করে এবং সেই দেবতার কাছে থেকে আমারই(ভগবান) দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করে।
তাই হিন্দুদের মূর্তিপূজা করার স্বাধীনতার আছে। তাই কেউ যদি মূর্তি পূজা করে সেটাও হিন্দু ধর্ম সম্বত আর কেউ যদি মূর্তি না করে সেটাও হিন্দু ধর্ম সম্বত, কারন হিন্দু ধর্মে ভগবান সাকার ও নিরাকার উভয় মাধ্যমে পূজিত হয়। হ্যাঁ তবে দেবদেবতার আরাধনা না করে এক ভগবানের আরাধনা করাই উৎকৃ্স্ট। কিন্তু এই উৎকৃ্স্ট পথে, এক লাফে যাওয়া কোনো দিনও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রথমে সাকারবাদি হতে হবে তারপর নিরাকারবাদি।
এখনো অনেক মুসলিম আছে যারা ঠিক মতো বুজতে পারে না ,কে এই আল্লা ? সে কোথাই থাকে ? আমি কেন এই আল্লার নিয়মগুলো মানছি ? এই সব, কিন্তু তারা কখনো নিজের মুখে স্বীকার করবে না ,তারা এগুলি কে নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, কখনো ব্যাক্ত করে না। বেশী কিছু না ওদের প্রশ্ন করবেন “আল্লা” কে? দেখবেন উত্তরে আল-কুরাণের কোনো বাণী শুনিয়ে দেবে। কারণ ওদের যা শেখানো হয়েছে, যা দেখেছে তাই তো ওরা বলবে। নিজের তো কোনো দার্শনিক জ্ঞান নাই, যে কারো শেখানো বুলি অবলম্বন না করে সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় আল্লা কে সেটা ব্যাক্ত করবে। যদি আল-কুরাণের “আল্লা” মুমিনদের জাহান্নামের ভয় না দেখাতো, তাহলে ইসলাম ধর্ম আর টিকতো না।
এর কারন তাদের ধর্মে এই “দর্শনের” সর্বাধিক অভাব আছে। এক হাজী বা মোল্লা বা পীর কে এই প্রশ্ন টা করবেন আর একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞানী সন্যাসী বা সাধু কে ঐ একি প্রশ্ন করবেন এবং তাদের উত্তর দুটোর মধ্যে কি পার্থক্য থাকবে তা আপনি নিজে বুঝতে পারবেন। এর কারণ একটায় তারা কোনো রকম আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দার্শনিক জ্ঞান না অর্জন করে এক লাফে নিরাকারবাদি অর্থ্যাৎ নিরাকার ঈশ্বর কে উপলগ্ধির দিকে গিয়েছে।
আশা করি সকলে মূর্তি পূজা কি এবং কেন করা হয় তা বুঝতে পেরেছেন।যারা সনাতনিদের প্রতিমা পূজা কে পৌত্তলিক বলে, তাঁদের দার্শনিক দারিদ্রতাই এখানে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।কারণ সনাতন দর্শনেই সাকার ও নিরাকার উভয় ধরনের উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বর পূজিত হন, আর এভাবে জগতের সকল মত আর পথকে সনাতন দর্শন তার অংশ করে নিয়েছে বলে সব পথেরই শেষ এক এই ঠিকানা।
“পলাশ চন্দ্র দেব নাথ”
||ওঁ শ্রী পরমাত্মনে নমঃ||
||ওঁ শান্তি,ওঁ শান্তি,ওঁ শান্তি||

হিন্দুরা কেন মৃতদেহ অথবা লাশকে পুড়িয়ে ফেলা?

শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭
হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে?
জানতে হলে পড়তে হবে।
অন্যকে জানাতে শেয়ার করুন।

প্রায়ই আপনার মুসলমান বন্ধুদের কাছে আপনাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় - হিন্দুরা কেন মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? কবরও তো দিতে পারতো বা অন্যকিছু করতে পারতো। পুড়িয়ে ফেলা কি অমানবিক নয়?
আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হই। প্রথমে যে ইনফরমেশনটি আপনার জানা প্রয়োজন তা হলো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করে অর্থাত মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপান থেকে শুরু করে চীন, করিয়া, ভারত ও অনান্য জাতি এই রীতি অনুসরণ করে। তাহলে আপনি প্রথমত: পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন : ১. পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি জাপানিরা কি তাহলে অমানবিক ? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কি অমানবিক ? যদি এই অর্ধেক মানুষ অমানবিক হয় তবে এদের মধ্যে কেন আমরা সবচেয়ে কম হানাহানি দেখতে পাই ?
আসুন এবার প্রকৃত উত্তরের দিকে যাই।

১. হিন্দুধর্মে কবর দেয়া বা সমাধি দেয়া নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা অনুমোদিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে সমাধি দেয়া হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায় কারও অপমৃত্যু হলে তার শব সমাধি দেয়া হয়, পোড়ানো হয় না।

২. আমরা কথ্য ভাষায় 'লাশ পোড়ানো' বলি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এটা 'অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া'। এটা আবার কী? অন্ত+ইষ্টি=অন্ত্যেষ্টি। ইষ্টি মানে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।
আমরা জানি, আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ ছিল যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু 'গর্ভাধান' থেকে জীবনের শেষ 'দেহত্যাগ' সবই হতো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। জীবৎকালে প্রতিদিনই পঞ্চমহাযজ্ঞ করতে হতো (এখনও করার বিধান)। এছাড়া অগ্নিহোত্র যজ্ঞের মতো বিবিধ যজ্ঞে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে 'হবি' (বর্তমানে পূজায় অর্ঘ্য নিবেদনের মতো) উৎসর্গ করা হতো। এ হলো ঈশ্বরের দেয়া জীবন ও দেহ দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রকৃতির উপাদানসমূহ ভোগ করার প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতাপূর্বক তাঁর উপাসনা করা। তাই অন্ত্যেষ্টি তথা জীবনের শেষ যজ্ঞে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দেহখানি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই 'হবি' বা অর্ঘ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়। এটা সত্যিই চমৎকার একটা ব্যাপার!

৩. প্রাচীন দর্শন অনুযায়ী বিশ্বচরাচর তথা আমাদের দেহও পাঁচটি ভূত বা উপাদান দ্বারা তৈরি। একে 'পঞ্চভূত' বলে। এগুলো হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। যারা বলেন 'মাটির দেহ' বা দেহ শুধু মাটি দিয়ে তৈরি, তাই একে মাটির সাথেই মিশিয়ে দেয়া উচিৎ, তারা অবশ্যই ভুল বলেন। বাস্তবে দেহ এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। শবদাহ করার মাধ্যমে দেহকে এই ৫টি উপাদানেই মিশিয়ে দেয়া হয় প্রত্যক্ষভাবে। দাহ শেষে অবশিষ্টাংশ জলে বিসর্জন দেয়া হয়। এজন্য শ্মশান সর্বদাই জলাশয়ের পাশে হয়ে থাকে।
অপরদিকে সমাধি বা কবর দিলে দেহ পঞ্চভূতে লীন হয় বটে, তবে পরোক্ষ ও ধাপে ধাপে। কারণ দেহ মাটির সাথে মেশে পঁচন প্রক্রিয়ায়। কোটি কোটি অনুজীব, পোকা-মাকড়ের খাবারে পরিণত হয় দেহ। এভাবে পঁচে গলে মাটিতে মেশানোই বরং দাহ করার চেয়ে বেশি অমানবিক মনে হয়।
একটা মজার তথ্য দিই। অনেক সময় আমরা বলি, লোকটা তো মরে ভূত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সে প্রকৃতিতে (পঞ্চভূতে) লীন হয়েছে -এটাই বুঝতে হবে।

৪. মৃত্যু হয় দেহের; আত্মার নয়। অবিনাশী আত্মা অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। এটা জগদীশ্বর পরমাত্মার অংশ। ('বিদ্রোহী' কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে কি?) জড় প্রকৃতির পঞ্চভূতে গড়া দেহ ফিরে যায় পঞ্চভূতে, আর জীবাত্মা ফিরে যায় পরমাত্মাতে। (মৃত্যুর পরে অবশ্যই আর কখনোই আপনি পুরনো দেহে ফিরে আসবেন না, বা কোন প্রকার শাস্তি/আজাব ভোগ করবেন না। শবদাহ করার পরে/মাটিতে মিশে যাওয়ার পরে নিশ্চয়ই লীন হওয়া দেহকে শাস্তি/আজাব যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়।)

৫. মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শোকের কোন ব্যাপার নয়। তীর্থস্থান বেনারস বা কাশীতে মৃত্যুও একটা উৎসবের ব্যাপার।
"জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ"-গীতা।
যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।

অতএব, দেহান্তরের নিছক সাধারণ ঘটনায় শোক কেন? বরং জরাজীর্ণ রোগশোকে আক্রান্ত দেহ ছেড়ে জীবাত্মার নতুন সুস্থ-সুন্দর দেহে জীবন আরম্ভের প্রাক্কালে মৃতকে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোই উচিত।


একম ব্রহ্ম কি?

রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭
হিন্দু ধর্মের মতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি ।
আজকের এই পোস্টটি পড়লে আপনি স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন ।
     সৃষ্টির শুরু 0 (শুন্য) ওম, এই ওম হলেন নিরাকার, অনেক শাস্ত্রে উনাকে ব্রহ্ম বলেও অবিবাহিত করা আছে, যেমন বেদএ বলা আছে একম ব্রহ্ম দ্বিতীয় নাস্তি, অর্থাৎ ব্রহ্ম ছাড়া সকলেই মিথ্যা, বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ব্রহ্ম ই হলেন সবকিছু যা কিছু আছে তাই ব্রহ্ম যেমন চন্দ্র সূর্য আকাশ মহাকাশ গাছ পালা জীব জন্তু ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু আছে সবকিছু মিলেই একম ব্রহ্ম পক্ষান্তরে তাহার ব্যাতিত সব মিথ্যা যেমন আমি যদি বলি নরেন্দ্র মোদীর দশটা মাথা আর বিষ টা হাত আছে সবাই বলবে না এটা মিথ্যা তাহার একটা মাথা ও দুইটা হাত আছে তেমনি ব্রহ্ম হলেন আছে বাকি কিছুই নাই । অর্থাৎ ব্রহ্ম হলেন সবকিছু, ব্রহ্ম হলেন ধারক বেদ অনুসারে তাই তিনি নিরাকার এবং তাহার কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, তাহার কোনো মূর্তি নেই, তাহার কোনো শরিক নেই তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা ।
  মোটামুটি শুরুটা সবাই বুঝছেন এবার আমরা জানবো তাহলে ব্রহ্ম কে অথবা কি? কেন তিনি নিরাকার? কেন তার কোনো মূর্তি নেই তার কোনো শরিক নেই ? তিনি নিজেই নিজে কিভাবে সৃষ্টি হলেন?
   ব্রহ্ম কে অথবা কি:-  ব্রহ্ম হলেন সবকিছু, মনে করুন একটা বড় আলমারি তার ভিতর জামা কাপড় টাকা পয়সা সোনা দানা হীরা জোহরত ইত্যাদি মজুত করে রাখা আছে পক্ষান্তরে বিড়ি সিগারেট গাজা মদ ইত্যাদি মজুত নেই । এখন ওই যে আলমারী ঠিক তেমনি ব্রহ্ম । বেদ অনুসারে পৃথিবী নক্ষত্র গ্রহ উপগ্রহ সাগর মহাসাগর ইত্যাদি কিছু নিদৃষ্ট জিনিষ নিয়ে হয় একটা ব্রহ্মমান্ড, গীতা অনুসারে অনন্ত ব্রহ্মমান্ড নিয়ে ব্রহ্ম । সুতরাং ব্রহ্ম হলেন যা কিছু এই সৃষ্টিতে আছে সবকিছু । ব্রহ্ম কোনো নিদৃষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু নন পৃথিবীতে যেমন সকল প্রাণীর বসবাস ব্রহ্মতে ও তেমনি অনেক পৃথিবী আর ব্রহ্মমান্ডের বসবাস সবকিছুর যেমন শেষ আছে এই ব্যাপারটা ও এখানেই শেষ অর্থাৎ ব্রহ্মর বাইরে কিছুই নাই ।
ব্রহ্ম কেন নিরাকার?
উত্তর অত্যান্ত সহজ আকার কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর থাকে, পৃথিবী একটা বস্তু তাই তার আকার আছে, মানুষ একটি ব্যাক্তি তাই তার আকার আছে ব্রহ্ম কোনো ব্যক্তি বা বস্তু নন তাই তার আকার নাই ।
ব্রহ্ম যদি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু না হন তাহলে তিনি কি জিনিস?
উত্তর সিম্পল আগেই বলছে বেদ অনুযায়ী ব্রহ্ম ব্যাতিত দ্বিতীয় সব নাস্তিক বা নাই, ভাই বাতাস উপলব্দি করা যায় দেখা যায় কি? যায় না বাতাস কি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু? না! তাপ উপলব্দি করা যায় দেখা যায় কি? এমনি অনেক কিছুই আছে যা দেখা বা ছোয়া বা আটকানো যায়না সেগুলো না কোনো ব্যক্তি না কোনো বস্তু সবটাই উপলব্ধি, ব্রহ্ম হলেন উপলব্দি ।
কেন তার কোনো মূর্তি নেই ?
 যেহেতু তিনি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু নন যাকে দেখা ছোয়া বা ধরা যায় না, জানাকে শুধু উপলব্ধি করা যায় তাহার মূর্তি কি করে হবে, তাই হিন্দুরা ব্রহ্মর কোনো মূর্তি বানায় নাই ।
তিনি নিজে নিজে কি করে সৃষ্টি হলেন?
 তিনি শুন্য থেকে সৃষ্টি হলেন, যেমন আমি এই পোস্টটি করার আগে এই জায়গাটা শুন্য ছিল আমার পোস্টটি এই শুন্য স্থানটা পূর্ণ করছে ঠিক তেমনি ব্রহ্ম এই অনন্ত ব্রহ্মমান্ড পূর্ন করেছেন উপলব্ধির দ্বারা ।

 ব্রহ্ম কি সৃষ্টিকর্তা?
উত্তর না ।
কেন?
কারণ ব্রহ্ম হলেন নিরাকার একটা উপলব্দি । আর শুধু উপলব্ধি কিছু সৃষ্টি করতে পারে না ।
  যেমন শব্দ ধনী উৎপন্ন করতে পারে কিন্তু ব্যাক্তি সেই ধনির দ্বারা কম্পনের সৃষ্টি করতে পারে ।
উৎপন্ন করা আর সৃষ্টি করার মধ্যে কি পার্থক্য ?
  উৎপন্য করা মনে হলো উৎপাদন করা যেমন জমিতে ফসল উৎপাদন করা । সৃষ্টি করা অর্থ তৈরি করা যেমন সেই উৎপাদিত দ্রব্য দ্বারা পিঠা তৈরি করা । সৃষ্টি করার জন্য উৎপাদনের প্রয়োজন হয় কিন্তু উৎপাদনের জন্য সৃষ্টি করা যায় না ।
  ব্রহ্ম হলেন উৎপাদনের উপকরণ আর তার উৎপাদিত ফসল হলেন স্রষ্টা । উৎপাদন উপকরণ কখনো বিনষ্ট হয় না বা ধ্বংস হয় না যেমন পাঠ উৎপাদিত হয় মাটি পানি থেকে । পাট থেকে আমরা জামা কাপড় ইত্যাদি সৃষ্টি করি আমাদের দ্বারা সৃষ্ট জামাকাপড় একদিন নষ্ট হয়ে আবার মাটিতেই ফিরে যায় ।
   আশাকরি পাঠক গণ এত সময়ে শুরুটা বুজে গেছেন, তো স্রষ্টার উৎপাদক যদি ব্রহ্ম হয় তবে স্রষ্টা কে?
  হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ব্রহ্মর উৎপাদিত ফসল হলন শ্রী হরি বিষ্ণু আর বিষ্ণু থেকে উৎপত্তি ব্রম্মা ও মহেশ ।
তো কথা কি দাঁড়ালো ব্রহ্ম থেকে উৎপত্তি বিষ্ণু আর বিষ্ণু থেকে উৎপত্তি ব্রম্মা ও মহেশ, অর্থাৎ উৎপাদন অংশ শেষ । এবার  সৃষ্টি অংশে যাবো আমরা :-
(উৎপত্তি অংশে কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাবেন ।)
   ভগবান বিষ্ণু ব্রম্মা এবং শিব মূলত একই কার্য ভেদে আলাদা ব্রম্মা সৃষ্টি করার কাজে মহাদেব শিব ধ্বংস করার কাজে আর সয়ং প্রভু বিষ্ণু রক্ষা ও পালন করার কাজে নিযুক্ত থাকেন । এই ত্রিদেব দের নিয়ে আমি পরবর্তী পোস্টে আলোচনা করবো ।
    এবার আসি সৃষ্টির শুরুতে :- ঋগ্বেদ অনুযায়ী এই উপলব্ধ বিস্ব ব্রহ্মমান্ডে যা কিছুই আমরা আজ দেখতে পাই না কেন এই সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদি সবকিছুই একটা সময় একত্রে পুঞ্জীভূত ছিল, সন্তান যেমন মাতৃ গর্ভের মাধ্যমে জন্ম নেয় তেমনি এই সারা সৃষ্টির যে গর্ভ থেকে জন্মেছে তাকে বলা হয় হিরন্ন গর্ভ ভগবান শ্রী হরি বিষ্ণু এই হিরণ গর্ভের মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টির রচনা করেন, সকল কিছুই এই গর্ভের ভিতর বিদ্যমান ছিল আর এই গর্ভ অতি তাপমাত্রায় প্রভাবিত হয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং সব কিছুর সৃষ্টি হয় । বর্তমানে বিজ্ঞানীরা যে বিগব্যাংক তথ্য আবিষ্কার করলেন তা ঋগ্বেদ এ হাজার হাজার বছর আগে থেকে লিখা আছে।
   যেহেতু ব্রহ্ম একটি শুন্য স্থান তাই হিরণ্য গর্ভপাত হবার কারণে দরুন গতি প্রাপ্ত বস্তু তার বেগে চলমান আছে সমবেগে সরল পথে, আর স্থির বস্তু গুলো স্থির অবস্থায় ই আছে (বেদ থেকেই নিউটন তার গতির সূত্র আর মহাকর্ষ বলিও সূত্র পান) ।
    যেমন নব গ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞান বেদেরই অংশ সূর্য সমস্ত সৌরমন্ডল নিয়ে ঘুরে, পৃথিবী তথা অন্য গ্রহ গুলো সূর্যকে নিয়ে ঘোরে । আর হিরণ্য গর্ভ থেকে উৎপন্য এই সমস্ত সৃষ্টিকে ব্রহ্মমান্ড বলে।
    সৃষ্টিকর্তা অতঃপর এই ব্রহ্মমান্ডে প্রানের সঞ্চার করেন আত্মার মাধ্যমে পরমআত্মা অর্থাৎ ব্রম্মা দেব এর মাধ্যমে, আত্মা পরম আত্মা হতে আসে পৃথিবীতে আত্মা পৃথিবীতে আসার পর তিন ভুবনের মায়াজাল চক্রে আবদ্ধ হয়ে যায়, তিন ভুবন হলো স্বর্গ, মর্ত ও নরক, স্রষ্টা সমস্ত আত্মার সমানতা বজায় রাখার জন্য তিন ভুবনের সৃষ্টি করেছেন "আত্মা পৃথিবীতে কর্ম করে মুক্তিলাভের জন্য আসে - কিন্তু পার্থিব মায়া আর পঞ্চভুতের শরীর আর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে সে তার মূল রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, এক জন্মে সে তার কর্মের দ্বারা মুক্তি প্রাপ্ত হতে পারেন না, তাকে বার বার জন্ম নিতে হয়, মৃত্যুর পর তার কর্মের ফল অনুযায়ী ক্ষনিকের বিশ্রামের জন্য স্বর্গ লাভ হয়, অন্য দিকে খারাপ কর্ম তথা আরাম আয়েস ও ধনির দুলাল হয়ে বসে বসে জীবন কাটানোর জন্য নরক প্রাপ্ত হয় এবং নরকে সম পরিমান কাজ করে জীবন এর সমতা প্রাপ্ত করতে হয় অন্ততায় স্বর্গ প্রাপ্ত আত্মা আর নরক প্রাপ্ত আত্মা উভয়কেই আবার মর্ত ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা প্রত্যেক আত্মাই কোনো না কোনো ভাবে পরম আত্মা প্রাপ্ত হন, গীতায় কর্ম যোগ অনুযায়ী সকাম কর্ম যার ফল আত্মা সরাসরি পেয়ে যান, কাজ করলে টাকা, প্রার্থনা করার সময় মানত ও ফল গ্রহণ ইত্যাদি অন্যদিকে নিষ্কাম কর্ম যার জন্য কর্তা ফলের আসা করেন না কিন্তু কর্ম সম্পাদন করে ফেলেন সেই কর্মের ফল সঞ্চয় হিসাবে স্রষ্টার কাছে থাকে এবং নিদৃষ্ট পরিমান হয়ে গেলে স্রষ্টা সেই আত্মার ফল স্বরূপ আত্মার মুক্তি দান করে থাকেন, কর্ম অনুযায়ী মানুষ বা অন্যান্য জীব পরবর্তী জন্ম পায়, কেউ কানা কেউ খুড়া কেউ ধোনি কেউ গরিব সব তার পূর্ব জন্মের কর্মের ফল অনুযায়ী হয়ে থাকেন । যুগ শেষে স্রষ্টা অবতার এর মাদ্ধমে অপরিতাপত্ত আত্মা যার সঞ্চয় হয় না তাদের মুক্তি দেন আর নব সূচনা করে যান ।
    দেব দেবী হলেন একটা সমাধান সৃষ্টির এ তথ্যের সমাধানের জন্য ধরে নেওয়া একটা সত্তা, যারা সৃষ্টি সঞ্চলনের জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মী, গীতায় ঈশ্বর বলে গেছেন যারা তাদের পার্থিব কামনা বাসনা পূরণের জন্য বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করে তাদের ভক্তি স্থাপন করেন আমিই তাদের ফল দেই, কিন্তু যারা আমারই সরনাপন্ন হন তারা আমাতে বিলীন হয়ে যায় তথা মুক্তি লাভ করে, কেউ 33 কোটি দেবতার কেউ 100 কেউ 500 তো কেউ 10, অন্য দিকে কেউ সাধু মহাপুরুষদের পূজা করেন তাদের সন্তুষ্ট করার জ্ন্য এই ভক্তি স্থাপনের জন্য ভক্ত কামনা বাসনা করেন, কিন্তু পরমআত্মার ভক্তিতে কামনা বাসনা থাকে না থাকে শুধু মুক্তির আর্তনাদ, হে আত্মা আজ তুমি ধোনির দুলাল কাল তুমি রাস্তার ফকির হবে রাস্তা ঘাটে ঘুমাবে, পুটপাতের পচা খাবার খাবে আজ যে জীবন তোমার কাছে মধুময় কাল তা বিষ হয়ে যাবে, আজ যৌবন কাল বুড়া, তাই মুক্তি লাভের খোঁজ করো ।
 জয় শ্রী কৃষ্ণ-